দুই যুগে বন্ধ হয়েছে ৭ বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান

বন্ধের পথে কর্ণফুলী পেপার মিল

নিজস্ব প্রতিনিধি, কাপ্তাই »

কাপ্তাইয়ে বিভিন্ন সমস্যা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে দুই যুগে বন্ধ হয়েছে কমপক্ষে সাতটি বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে উপজেলায় যে কয়টি শিল্প কারখানা চালু রয়েছে সেগুলোও নানা সমস্যার বেড়াজালে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে।

জানা গেছে, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরপরই ১৯৬৫ সালে কাপ্তাই এলাকাকে শিল্প জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পার্বত্যাঞ্চলের বিস্তৃত বনভূমি ও বৃক্ষরাজির বিশাল ভা-ার কাঁচামালের অফুরন্ত উৎস হিসেবে এ এলাকায় কাঠ ও বাঁশ ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। ক্রমেই এ এলাকায় শিল্প বিপ্লব ঘটে। গড়ে ওঠে কাপ্তাই কর্ণফুলী কাঠ আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট, কাপ্তাই লাম্বার প্রসেসিং কমপ্লেক্স, ইস্টার্ন টিম্বার লিমিটেড, শীলছড়ি ইস্টার্ন টিম্বার অ্যান্ড প্লাইউড ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি লিমিটেড, লেমউড লিমিটেড ইত্যাদি অসংখ্য ছোটবড় বেসরকারি শিল্প কারখানা। অবশ্য এসব শিল্প কারখানা ও কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের আগেই ১৯৫৩ সালে একসময়ের এশিয়ার বিখ্যাত কর্ণফুলী কাগজকল এবং কর্ণফুলী রেয়ন অ্যান্ড কেমিক্যালস্ লিমিটেড স্থাপিত হয়। এছাড়া কর্ণফুলী পেপার ও রেয়ন মিল স্থাপনের উদ্দেশ্যে চন্দ্রঘোনা এলাকায় সর্বপ্রথম স্বয়ংক্রিয় মেশিনে ইট তৈরির একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এদিকে কাপ্তাই হ্রদ পথে যোগাযোগ সৃষ্টি এবং দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হতে যান্ত্রিক ও প্রাকৃতিক উপায়ে আহরণকৃত কাঠ, বাঁশ কারখানাগুলোর কাঁচামাল হিসেবে যোগান দেওয়াসহ কারখানায় নিয়োজিত মানুষের পদভারে কাপ্তাই পরিণত হয় কর্মচঞ্চল এলাকায়। কাপ্তাই এলাকায় গড়ে ওঠা কাঠভিত্তিক শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী এবং বাঁশ ও গাছ ভিত্তিক কর্ণফুলী পেপার মিলের কাগজসহ রেয়ন মিলে উৎপাদিত পণ্য জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তান আমলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কর্মচারী নিয়ে কলকারখানাগুলো পুরোদমে চালু এবং ব্যাপক হারে মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়।

কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে নানা অনিয়ম, বিশৃংঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ প্রশাসনিক অদক্ষতা, অসহযোগিতার কারণে এসব কারখানায় নানান সমস্যা দেখা দেয়। লোকসান প্রতিষ্ঠান হিসেবে অথবা তৎকালীন সরকারি ভ্রান্তনীতির কবলে পড়ে একে একে শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হতে থাকে। আশির দশকে শীলছড়িতে অবস্থিত একেখান প্লাইউড লিমিটেড, ইস্টার্ন টিম্বার অ্যান্ড প্লাইউড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রুবিপ্লাইউড লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯২-৯৩ সালে চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত স্বয়ংক্রিয় মেশিনে ইট তৈরির কারখানাটি অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ২০০২ সালের ১৫ ডিসেম্বর কর্ণফুলী রেয়ন অ্যান্ড কেমিক্যালস্ (কেআরসি) লিমিটেড বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ কাপ্তাই বিএফআইডিসির আওতাধীন সংগ্রহ ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান (পিএসও) পে-অফের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৫ সালের ৩১ মার্চ বিএফআইডিসির নিয়ন্ত্রণাধীন কর্ণফুলী কাঠ আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিটকে পে-অফের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সমস্ত শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার পর বছরের পর বছর ধরে অযতেœ-অবহেলায় পড়ে থাকা শত শত কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন মূল্যবান যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক যন্ত্রাংশ চোরাইপথে পাচার হয়ে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। শিল্পাঞ্চল কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন কলকারখানা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারীও বেকার হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে উপজেলায় যে কয়টি শিল্প কারখানা চালু রয়েছে সেগুলোও নানা সমস্যার বেড়াজালে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ টিম্বার অ্যান্ড প্লাইউড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের দুটি ইউনিটে বর্তমানে কাঁচামালের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এক সময়ের এশিয়ার বিখ্যাত চন্দ্রঘোনাস্থ কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড (কেপিএম) কাগজ উৎপাদন করে দেশব্যাপী কাগজের চাহিদা মিটিয়ে আসছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সমস্যা ও কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন সর্বনি¤œ নেমে এসেছে। করোনা মহামারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাগজ ক্রয়ের ওয়ার্ক অর্ডার না দেওয়া এবং কাঁচামাল বাঁশ ও নরমকাঠ (পাল্পউড) ক্রয় বন্ধ থাকায় মিলটি বছরের পর বছর অব্যাহত লোকসান গুনতে হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে চলতি আর্থিক বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম কাগজ উৎপাদন হয়েছে। বর্তমানে উপজেলায় যে কয়টি শিল্প কারখানা চালু রয়েছে সেগুলোও নানা সমস্যার বেড়াজালে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ফলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

কেপিএমের ওয়াকার্স ইউনিয়নের সভাপতি গাজী নাসির বলেন, মিলের সার্বিক পরিস্থিতি ও স্বাভাবিক উৎপাদনের লক্ষ্যে এখনই সরকারের সর্বোচ্চ মহল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়োজনে কেপিএমের নিজস্ব কূপ থকে আবারো কাঁচামাল বাঁশ ও নরমকাঠ (পাল্পউড) সংগ্রহ করে তা দিয়ে কাগজ উৎপাদন করে মিলকে সচল রাখা সম্ভব।

কর্ণফুলী পেপার মিলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (উৎপাদন) মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, কারখানায় অবিক্রিত অবস্থায় প্রচুর কাগজ পড়ে আছে। এনসিটিবি এক হাজার টন কাগজের অর্ডার দেয়। অথচ এনসিটিবি আড়াই থেকে তিন হাজার টন কাগজ নিত।