দুঃখীর দরদী সুলতানুল হিন্দ্ গরীব-নওয়ায

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

আল্লাহ্ তাআলাই সমস্ত প্রশংসা, গুণগান ও আরাধনার মালিক, যিনি নিজ রহমত ও মেহেরবানী দিয়ে তাঁর সৃষ্টিজগতকে লালন-পালন করেন। তাঁর পবিত্রতার জপ করি, যিনি মুমিন নর-নারীর অন্তর জগতকে কুফ্র ও শির্ক’র কলুষতা হতে পবিত্র রাখেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি কৃতজ্ঞ বান্দার জন্য নেয়ামত বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহ্ এক, তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর শান, ‘ওয়াহ্দাহু লা-শারীকা লাহ্’। তাঁর সমকক্ষ, সমগোত্র বলতে কেউ নাই, কিছুই নাই। তাঁর প্রভুত্বে কারো অংশীদারিত্ব নেই। তিনি বাধ্য নন, মুখাপেক্ষী নন। সৃষ্টিকূল মুখাপেক্ষী। আল্লাহ্রই ইচ্ছায় আমরা সৃষ্ট। আমাদের পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা। তিনি আমাদেরকে বন্দেগীর তা’লীম দিয়েছেন। তিনি আল্লাহ্র রাসূল।
মাহে রজব অনেক বৈশিষ্ট্যের কারণে উৎসবের মাস রূপে কলরব মুখর। যেমন এর প্রথম রাত ‘লাইলাতুর রাগায়িব’। যা অনেক রিয়াযত (সাধনা)কারী মুমিন নর-নারীর ইবাদত বন্দেগীতে বিনিদ্র অতিবাহিত হয়েছে। সূচনার রাতটি কাটে সজাগ, সচেতনতায়। এ মাসে অনেক বরেণ্য ইসলামী মনীষী ও সাধক প্রবরের তিরোধান হওয়ায় তাঁদের স্মৃতিচারণের বর্ণাঢ্যতায়ও সমুজ্জ্বল হয়ে থাকে মাহেরাব। বিশেষত এ উপমহাদেশের অলি-আওতাদ, পীর-দরবেশগণের ভক্ত প্রেমিকদের প্রাণোচ্ছ্বাসে সরগরম থাকে মাসটি। তন্মধ্যে সবিশেষ যাঁর কথা সর্বাগ্রে উঠে আসে, তিনি হলেন গরীব-নওয়ায খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতী আজমেরী আল হুসাইনী ওয়াল হাসানী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বিশ্বজনীন আরো অনেক সাহাবী, গাউস কুতুবসহ অনেকের ওফাতের স্মৃতিবহ এ রজব মাস। ইমাম জা’ফর সাদেক, ইমাম মুসা কাযিম, আমীরে মুআবিয়া, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আবু ইউসুফ, জুনাইদ বাগদাদী, আল্লামা নকী আলী খাঁ, বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রামে ইমাম শেরেবাংলা (আলাইহিমুর রাহমাতু ওয়ার রিদ্বওয়ান)-এঁরা সকলে এ চাঁদেই ওফাত পান। এতদঞ্চলের মানুষ ঈমান’র দৌলতে ধন্য হয়ে নাজাতের শর্ত পূরণ করতে পেরেছেন যে মহান সাধকের প্রাণপণ সাধনার ফলে, তিনি খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাদ্বি.)। সঙ্গত কারণেই তাঁর অবদান সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। ঈমান হলো পারলৌকিক মুক্তির প্রথম শর্ত। আমল না থাকলেও ক্ষমায় মুক্তিলাভের অবকাশ আছে; কিন্তু ঈমান ছাড়া নাজাত নেই। মুক্তির মূলমন্ত্র পাক-ভারত উপমহাদেশে নিয়ে এসেছেন খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাদ্বি.)। আর তা হলো দওলতে ঈমান।
খাজা গরীব-নওয়ায’র প্রসিদ্ধি একাধিক উপাধি ও উপনামে দেখা যায়। জন্মস্থান নিরিখে তিনি ‘সাঞ্জারী’ নামে প্রসিদ্ধ। তবে কোন্ ‘সানজার’ তাঁর জন্মস্থান, তাতে মতানৈক্য রয়েছে। এ নামে পারস্যের তিন বিখ্যাত নগরের তিনটি অঞ্চলই রয়েছে। ইসফাহান, মোসেল ও সিস্তান বা সাজিস্তান। আবার জন্মস্থান সানজার’র মত তাঁর জন্মসনেও মতান্তর দৃষ্ট হয়। কোন জীবনীকারের মতে ৫৩০ হিজরী, কারো মতে ৫৩৭ হিজরী। তারিখ ১৪ রজব. সোমবার। সুবহে সাদিক’র সময় তাঁর শুভজন্ম। তবে তাঁর ইন্তেকালের তারিখ ৬ রজব, এতে দ্বিমত নেই। ওফাত সন ৬৩২ হিজরী। তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার নাম খাজা গিয়াসুদ্দীন আহমদ। তাঁর ঊর্ধ্বতন দ্বাদশ পুরুষ ঈমাম হুসাইন এবং মায়ের নাম সায়্যিদা উম্মুল ওয়ারা’। তাঁর ১০ম ঊর্ধ্বতন পুরুষ ইমাম হাসান (রাদ্বি.)। পিতা-মাতা উভয়কুলে তিনি আলে রাসূল। বাল্যকাল না কাটতেই তিনি পিতা-মাতাকে হারান। পৈত্রিক সম্পদ একটিমাত্র ফলের বাগান বিক্রি করে সব গরীব দুঃখীকে দান করে দেন। এবার নিঃস্ব অবস্থায় অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। বিভিন্ন স্থান ঘুরাফেরার পর বুখারায় যুগশ্রেষ্ঠ আলেম হযরত হেশামুদ্দীন’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শ্রদ্ধেয় পিতাও একজন উচ্চতর আলিম ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এখানে টানা সাত বছর ব্যুৎপত্তিসহ কুরআন, হাদীস’র পাশাপাশি ফিকাহ-ফতওয়ার গভীর জ্ঞানার্জনে ব্রতী হন। এছাড়াও সমকালীন দক্ষ আলিমগণের সাহচর্যে থেকে জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণ করেন। এরপর আসেন ইরাকের বাগদাদ নগরে। জাহেরী ইলম অর্জন শেষে মা’ রেফতের গূঢ় তত্ত্ব ও রহস্য জ্ঞান অর্জন এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে তিনি এবার নিশাপুরের খাজা ওসমান হারুনীর খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। তারপর শুরু হয় তাঁর আধ্যাত্ম সাধনার দীর্ঘ পথচলা।
গরীবÑনওয়াযের জীবন গাঁথা পাকভারতের প্রথিতযশা অনেক লেখকের হাতে লিখিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। এ পরিসরে তাঁর জীবনালেখ্য নয়; বরং এ বিশাল, বর্ণাঢ্য জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে তাঁর জীবনের খ-চিত্রে আলোকপাত করা আজকের প্রতিপাদ্য। কারণ, এ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নিছক একজন ব্যক্তিই নন, প্রতিষ্ঠান বললেও তাঁকে খাটো করা হবে। দেশকাল’র গ-ি ছাড়িয়ে মহাকালব্যাপী ভাবনার অন্তলান্ত সমুদ্র তিনি। হযরত ইসমাঈল (আ.)র শৈশবকালে তৃষ্ণাকাতরতায় নাজুক গোড়ালীর ঘায়ে নির্গত ‘যমযম’র অকুল পাথার আজো অফুরান নিঃস্বরণ রূপে বিদ্যমান রয়। আমাদের কল্পনার পাখি কতটুকুই আর উড্ডয়নে সক্ষম হবে?
যবীহুল্লাহ্র শিরায় শিরায় যে নূরের তরঙ্গ বহমান, খাজা গরীব-নওয়ায তো সেই শোণিতের উত্তরাধিকারী। তাঁর ঐতিহাসিক কারামত’র স্বাক্ষী আনা সাগর সে জিজ্ঞাসার তরঙ্গে বিক্ষুব্ধ, সে খাজার পূর্বপুরুষ ইমাম হুসাইন কি পানির তৃষ্ণাতেই কাহিল হন? মালিকে কাওসার’র দৌহিত্র কি এক ঢোক জলের কাঙাল? কাওসার’র পেয়ালা উম্মতকে বিলাবেন কে?
খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.)র মূল নাম সায়্যিদ হাসান। তাঁর উপাধি, লকব অনেক। যেমন, মুঈনুদ্দীন তাঁর লকব। এভাবে তিনি প্রসিদ্ধ ‘খাজা’ পরিচয়ে। তবে ব্যাপকভাবে তাঁর চর্চিত লকব ‘গরীব-নওয়ায’। ভক্তেরা গরীব-নওয়ায’ বলতে ও শুনতে দিওয়ানা। শব্দটি ফার্সি ভাষার। এটি যুগ্মশব্দ। গরীব’র অর্থ সবাই জানেন। ‘নওয়ায’ অনুজ্ঞা সূচক। সংযুক্তির ফলে কর্তৃবাচক বিশেষ্যের অর্থ প্রদান করে। অর্থাৎ গরীবের নওয়ায বা অনুগ্রহকারী। তাঁর আচরণ বৈশিষ্ট্যে এই মহৎ গুণটি অধিকতর উজ্জ্বল। তাঁর সেই মহানুভবতার ওপর আলোকপাত করার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা। শৈশব থেকে তাঁর গুণটি প্রকাশ পেতে শুরু করে। ছেলেবেলার কথা। এক ঈদের সকালে বাবার সাথে তিনি ঈদগাহে যাচ্ছেন। পথে এক অন্ধ বালককে দেখতে পেলেন। যার পরনে ছিল ছিন্ন, ময়লা বসন। মলিন চেহারায় তাকে বড় অসহায় দেখা গেল। তাঁর অন্তর হাহাকার করে ওঠলো। অল্পবয়সী গরীবÑনওয়ায কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর বাবাকে কিছু না বলেই নিজের পরনের নতুন জামা হঠাৎ খুলে ফেললেন। গরীব, অন্ধ বালকটিকে পরিয়ে দিলেন। আর অতি উৎফুল্ল মনে বাবার সাথে ঈদগায় রওয়ানা হলেন। মনে মনে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। পিতা তাঁর এসব কার্যকলাপে কোন রূপ মন্তব্য করলেন না বটে; কিন্তু আনন্দে গর্বে তাঁর পিতৃহৃদয় আপ্লুত হয়ে গেল। আল্লাহ্র কাছে অজ¯্র শুকরিয়া জানালেন।
অনুরূপ আরেকটি ঘটনায় তাঁর জননীও অভিভূত হয়ে যান। একদিন খাজা গরীব-নওয়ায নিজ বাড়ির পাশেই এক অপরিচিত বালককে দেখতে পেলেন। ছেলেটি নিজ মনে খেলছিল। তার মলিন বেশ, দীন-দুঃখী মনে হল। তাকে দেখে বালক গরীব-নওয়াযের মনে হল সে অভুক্ত। তিনি তখনই ছেলেটির হাত ধরে নিজ ঘরে নিয়ে গেলেন। মা জননী তাঁরই জন্য আহার নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। গরীব–নওয়ায পরম আদর-যতœ ও মমতাভরে নিজের খাবারটুকু ওই ছেলেটিকে খাওয়ালেন। পুত্রের এমন সহানুভূতি ও গরীব দরদী কাজ দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে হাত তুলে বললেন, ‘আল্লাহ্’, তার এমন স্বভাব প্রকৃতি যেন সারাজীবন থাকে, তোমার বান্দাদের যেন ব্যাপক কল্যাণ সাধন করতে পারে। তাকে সেভাবে কবুল করে নাও’। (ফজলুর রহমান মুন্সী কৃত জীবনী গ্রন্থ দ্র.) আল্লাহ্ তাআলা তাঁর কারণে অসংখ্য মানুষকে ঈমান দিয়েছেন। আজ অবধি বিপন্ন মানবতার সাহায্যে তাঁর রূহানী ফয়েয জারি রয়েছে।
আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নিজের পরিচয় দেন রাব্বুল আলামীন। সমগ্র জাহানের তিনি পালনকারী। এ কারণে তিনি সবার জন্য ‘রাহমান’ বা অতিশয় দয়ালু। দয়া ছাড়া সৃষ্টির প্রতিপালন হয় না। আল্লাহ্র হাবীব রাহ্মাতুল্লিল আলামীন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘পৃথিবীবাসীর প্রতি সদয় হও, আসমানের মালিক তোমাদেরকে দয়া করবেন’। আল্লাহ্ আমাদের অন্তরেও দীন-দুঃখীদের জন্য সমবেদনা জাগিয়ে দিন।

লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।