থামছে না পাহাড়ধসে মৃত্যু

ভূঁইয়া নজরুল »

বর্ষায় বৃষ্টি হবে, সেই বৃষ্টিতে বালি-মাটির পাহাড় ধসেও পড়বে। কিন্তু মৃত্যু ঠেকাতে পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ নানা কর্মসূচি নেওয়া হলেও সব কিছুকে ভুল প্রমাণ করে বছরের পর বছর পাহাড় ও দেয়াল ধসে মানুষের মৃত্যু ঘটছেই। ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ও দেয়াল ধসে ১৩২ জনের প্রাণহানির মাধ্যমে যে শবযাত্রা শুরু হয়েছিল এপর্যন্ত তা ২০৯ জনে গিয়ে ঠেকেছে।

গত শুক্রবার গভীর রাতে আকবর শাহ থানাধীন যে দুটি স্থানে পাহাড় ধসে চারজনের মৃত্যু হয়েছে সেই দুটি স্থানে যাওয়ার জন্য ঢালাই করা রাস্তা কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নির্মাণ করেছে। ফয়’স লেক এক নম্বর ঝিল এলাকায় প্রায় আধা কিলোমিটারের বেশি রাস্তার শেষ প্রান্তে পাহাড়ের ঢালে থাকা ঘরটি বিধস্ত হয়। আর এতে দুই বোনের মৃত্যু হয়। একইসাথে আকবরশাহ থানাধীন লেকসিটি আবাসিক এলাকার পূর্ব পাশের কনকর্ডের পাহাড়ে ( রেলওয়ের মালিকানাধীন) যাওয়ার জন্যও ঢালাই করা রাস্তা রয়েছে। প্রায় দুইশ ফুট উঁচু পাহাড়ের ঢালে যে ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল তা ধসে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়। শুধু এবছরই নয় প্রায় প্রতিবছরই এসব এলাকায় মানুষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

পাহাড়ধসে যতো মৃত্যু

২০০৭ সালের ১১ জুন প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় ও দেয়াল ধসে ১৩২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেবার নগরীর বাঘঘোনা, কুসুমবাগ আবাসিক এলাকা, সেকান্দারপাড়া ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। পারবর্তীতে ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট পাহাড়ধসে লালখান বাজারের মতিঝর্ণায় একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১১ সালে টাইগারপাস বাটালি হিলের দেয়াল ধসে মারা যায় ১৭ জন, ২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন নগরীর মতিঝর্না, আমবাগান, আকবর শাহ, কৈবল্যধাম বিশ্বব্যাংক কলোনী, জালালাবাদ ও হারবাতলী এলাকায় পাহাড় ও দেয়াল ধসে ২৪ জনের মৃত্যু হয়, ২০১৩ সালের ২৮ জুলাই মতিঝর্নায় দেয়াল ধসে মারা যায় ২ জন এবং ২০১৫ সালে আমিন কলোনী ও লালখান বাজারের মতিঝর্নায় পাহাড় ও দেয়াল ধসে ৬ জনের মৃত্যু এবং একইবছরে আরো দুই জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে নগরীতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও ২০১৭ সালের জুনে নগরীতে দুই ঘটনায় ৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর পাহাড়ধসে মারা যায় ৪ জন। পরবর্তীতে কয়েক দফা ধস হলেও প্রশাসনের নজরদারির কারণে মৃত্যুও ঘটনা ঘটেনি। গতকাল মারা গেল চারজন।

কেন থামছে না মৃত্যু

২০০৭ সালের ১১ জুনের ঘটনার পর মৃত্যু ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি অনেকগুলো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেসব কমিটি রিপোর্টও প্রদান করে। প্রতিবছর সেই কমিটি সমন্বয় সভাও করে। সেসব সভায় পাহাড়ে বসতিদের বসবাস করতে নিরুৎসাহিত করতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়। বর্ষা মৌসুম এলেই মাইকিং করা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ বসতিদের উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তারপরও থামছে না মৃত্যু। এর কারণ জানতে চাইলে পাহাড় রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসা পরিবেশকর্মী শরীফ চৌহান বলেন,‘বৃষ্টি হবে এবং সেই বৃষ্টিতে পাহাড় ধস হবেই। এটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এই ধস ঠেকাতে এবং মৃত্যু ঠেকাতে তদন্ত কমিটি অনেকগুলো সুপারিশ করেছিল। সেসব সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই বারবার মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।’

চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাহাড় ধস ঠেকাতে প্রকৌশলগত পরামর্শ দিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসির উপাচার্য প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন,‘ চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর উপরের দিকের ১০ থেকে ১৫ ফুট বালি মাটির। টানা বৃষ্টি হলে এসব বালি মাটি নিচের দিকে ধসে পড়ে। কিন্তু পাহাড়গুলো খাড়াভাবে কেটে সেই পাহাড়ের পাদদেশে বসতি নির্মাণের কারণে ধসে পড়া মাটিতে চাপা পড়ে মানুষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।’

এদিকে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আশরাফ উদ্দিন বলেন,‘ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু উচ্ছেদের পর তারা আবার গিয়ে বসবাস শুরু করে। তাই মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।’

কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের রাস্তাঘাট নির্মাণ করে দেয়া কি পাহাড়ে তাদের বসবাসকে উৎসাহিত করছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘আমরা সবসময় পাহাড়ে বসবাসকে নিরুৎসাহিত করে আসছি। এখন যেহেতু সিটি কর্পোরেশন সেখানে রাস্তা নির্মাণ করেছেন সেবিষয়ে তারাই ( সিটি কর্পোরেশন) ভালো বলতে পারবেন।’

গতকাল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র গিয়াস উদ্দিন। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে রাস্তা নির্মাণ করে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘ এসব এলাকায় অনেক আগে থেকেই মানুষ বসবাস করছে। যদি এসব বসতি অবৈধ হতো তাহলে প্রশাসন তা উচ্ছেদ করে দিলেই হতো। এখন যেহেতু মানুষ বসবাস করছে, তাই মানবিক বিবেচনায় সিটি কর্পোরেশন তাদের চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মাণ করে দিয়েছে।’

চলবে ব্যাপক হারে উচ্ছেদ অভিযান

শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আশরাফ উদ্দিন বলেন,‘ আমরা কাল ( রোববার) বড় আকারের একটি ড্রাইভ দিবো। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ যেসব বসতি রয়েছে সেগুলো উচ্ছেদে ক্র্যাশ প্রোগাম চালাবো। ইতিমধ্যে ২০টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে থাকা ও খাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।’

বাস্তবায়ন হয় না সুপারিশ

২০০৭ সালের ঘটনার পরপরই তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এম এ এন ছিদ্দিককে আহবায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটি ১৮ পাতার তদন্ত রিপোর্টে পাহাড় ধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করে ৩৬ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। এছাড়া ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলামকে প্রধান করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ‘পাহাড়ধস ও ভূমিধসের কারণ উদঘাটন ও ঝুঁকির মাত্রা কমানোর উপর সুপারিশ প্রণয়ন’ শীর্ষক সেই রিপোর্টে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী তিন ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর মোজাম্মেল হককে প্রধান করে একটি কারিগড়ি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটিও পাহাড় না কাটা, পাহাড়গুলোর ঢাল ৩৫ ডিগ্রিতে রাখা, পাহাড়ে বৃক্ষরোপণ করা, পাহাড়ের মালিকদের নিজ উদ্যোগে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করাসহ অনেকগুলো সুপারিশ দিয়েছিল। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ধসে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হচ্ছে না বলে অনেকের মত।