জশ্নে ঈদে মিলাদুন্নবী : শ্রেষ্ঠতম পুণ্য আমল

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

সর্বশক্তিমান, রহীম ও রাহমান মহান আল্লাহ্র হাম্দ ও সানা দিয়ে শুরু, যিনি পবিত্র কুরআনের সূচনায় হাম্দ’র অবতারণা করেন তাঁর পবিত্রতা জ্ঞাপন করি, যিনি তাঁর ইবাদতের জন্য পবিত্রতার শর্তারোপ করেছেন। কৃতজ্ঞতা সেই দয়াময় প্রভুর, যিনি প্রিয়নবীকে উম্মতের কাছে প্রেরণ করে তাঁর অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন।
আল্লাহ্র একত্বের উচ্ছ্বসিত ঘোষণায় পুলকিত হই, যিনি একমাত্র উপাস্য ওয়াহ্দাহু লাÑশরীকা লাহ্। আমাদের মুনিব, সত্যের পথদ্রষ্টা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র নিকটতম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল।
বারই রবিউল আউয়াল শরীফ। সৃষ্টিজুড়ে আনন্দের প্লাবন। যে আনন্দ দেখে স্বয়ং ¯্রষ্টাও পুলকিত। যে কারণে এ দিনটিও শ্রেষ্ঠতম স্মরণীয়, বরণীয় দিন। সে খুশিতে একমাত্র শয়তান ছাড়া সৃষ্টির সকলেই আনন্দিত, পুলকিত। শ্রেষ্ঠতম এদিনেই বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশিত হয়েছে মহান আল্লাহর মূর্ত করুণা, সৃষ্টির রূপ ধরে ধরাধামে নেমে আসে খোদার শ্রেষ্ঠতম নেয়ামত, আমিনার দুলাল রহমতুল্লিল আলামীন (দ.)।
সৃষ্টিকুল আজ আনন্দে আটখানা। ‘আজকে খুশীর ঢল নেমেছে ধূসর সাহরায়’Ñজাতীয় কবি নজরুলের না’তের কলিটি বাংলাদেশের সর্বত্রও যেন জীবন্তরূপে কলকলিয়ে ওঠছে। হবে না কেন? এ যে হায়াতুন্নবীর শুভ আগমনীর সুখবারতা। মুসলিম বিশ্বের দেশে দেশে সকলেই যে প্রিয় নবীকে ‘রহমত’ রূপে লাভ করা, পৃথিবীতে আবির্ভূত সর্বযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মহামানব, শ্রেষ্ঠ নেয়ামতকে ধরাধামে পাওয়া মহান দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার উচ্ছ্বাস আনন্দের অবগাহনে মেতে উঠেছে। এ দেশের বন্দর নগরীর রূপÑচিত্র আরো বেশি দৃষ্টিকাড়া। কারণ এখানেই পালিত জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবীর বর্ণাঢ্য সমারোহ, জুলুসের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, নবীপ্রেমিক মুমিনদের জনসমুদ্রের মত জমায়েত, সাগরের পানে ছুটে চলা ¯্রােতস্বিনীর মত বাঁধভাঙা কলধ্বনি ও সম্মোহিত ছুটে চলা জন¯্রােত’র অনাবিল দৃশ্য চোখ জুড়াবেনা কার? এর বৈশিষ্ট্য এই গণজোয়ারের মত বিশাল, ব্যাপক, চিত্তহরা পুণ্যের বাঁধভাঙা জন¯্রােতের ঐতিহাসিক জশনে জুলুস’র মহান স্থপতি যে প্রিয়নবীরই বংশজাত এক মহান সাধক পুরুষ! হ্যাঁ, তিনি আÑলে রাসুল গাউসে যমান, বরেণ্য যুগসংস্কারক আল্লামা সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ (রাদ্বি.)। যে নবীর শুভাগমনের স্মৃতি উদযাপনে এ জুলুস, তিনি তাঁরই ঔরসজাত ৪০তম ধারার আওলাদে পাক। যাঁর হাতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে গাউসিয়া কমিটির মত বিশ্বনন্দিত আধ্যাত্মিক সংগঠন, যা মানবতার সেবায় ব্যতিক্রমী ইমেজ সৃষ্টি করে তাক লাগিয়েছে সমকালকে। মানব সমাজে নিন্দিত হওয়া যত সহজ, নন্দিত হওয়া তত সহজ নয়। বলা সহজ, করাটা কঠিন। ‘জশনে জুলুস’ নিয়ে বিতর্ক করার মত আপনÑপর অনেকেই আছে। তবে ভেবে দেখা উচিত প্রয়াসটা কার উদ্দেশ্যে নিবেদিত? আগেই উল্লেখ হয়েছে, নবীপ্রাপ্তির খুশিতে এটি আনন্দের অবগাহন। তাই এ আনন্দের যে শরয়ী সমর্থন আছে, এ ইস্যুতে সমর্থন ও যুক্তি সাপেক্ষ দু’একটি উদ্ধৃতি কুরআন হাদীস’র আলোকে দিতে চাই। প্রথমত পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্র নির্দেশনা, ‘আল্লাহ্র অনুগ্রহ, দয়া প্রাপ্তিতে বান্দাদের খুশি হওয়া উচিত। কেননা, তা পার্থিব ও অপার্থিব সমুদয় সঞ্চয় হতেও অধিক উত্তম’। আয়াতের প্রথমাংশে বলা হয়েছে, ‘হে মাহ্বুব (দ.) আপনি বলে দিন, ‘ফদ্বল ও রহমত পেলে তারা যেন আনন্দিত হয়, খুশি প্রকাশ করে’। (সুরা ইউনুস: আয়াত-৫৯)
সৃষ্টিকুলের অস্তিত্বের মহান ওয়াসীলা হুযূর আনওয়ার (দ.) আল্লাহ্র প্রধান অনুগ্রহ। (আÑলে ইমরানের ১৬৪তম আয়াত দ্র.) পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা যে, তিনি কুলÑকায়েনাতের জন্য ‘রহমত’। (সুরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াত দ্র.) কাজেই পবিত্র কুরআনের নির্দেশনায় নবী আগমনের স্মৃতিতে পুলকিত হওয়া, খুশিতে দিনটি উদযাপন করার মধ্যে আপত্তি করা কুরআনকে অগ্রাহ্য করার শামিল।
আবার দুর্মুখদের দুরভিসন্ধিমূলক একটা আপত্তি এটাও শোনা যায় যে, নবীজি তো ওই তারিখে ওফাতও বরণ করেছেন, ‘তাই দুঃখ না করে আনন্দ কেন? জবাবে বলা যায়, যে কোন মৃত্যুতে তিন দিনের অধিক শোক নিষেধ। আর সৃষ্টির নিয়মে নবী পাক (দ.) ওফাত বরণ করেও তিনি হায়াতুন্নবী। তিনি উম্মতকে নিয়ে এ ধরাধামেই আছেন, আল্লাহ্র ইচ্ছা হলে কোন উম্মতের কাছে সশরীরে তাশরীফ ও আনতে পারেন। তাই উম্মত শোক দিবস নয়, তাঁর শুভ বেলাদতে মিলাদুন্নবীর খুশি পালন করে। এ নির্দেশ পবিত্র কুরআনের।
জশ্ন কী? শব্দটি ফার্সি। অভিধানে এর অর্থ খুশির জলসা, মাহফিল আহবান, আনন্দের দিবস উদযাপন ইত্যাদি। প্রচলিত অর্থ বর্ণাঢ্যতা, শোভা, সমারোহ, জাঁকজমক, আড়ম্বর, ঘটা প্রভৃতি। জুলুস আরবি শব্দ। এরও একাধিক অর্থ অভিধানে পাওয়া যায়। বিশেষ কোন উপলক্ষ নিয়ে বহু লোকের জমায়েত, বাজার, সদর রাস্তা অতিক্রম করা, বাদশাহ্র সওয়ারী বের হওয়া, রাজকীয় বৈঠক, সমাবেশ ইত্যাদি। বর্ণিত অর্থগুলো যে উপলক্ষেই করা হোক, এর যথার্থতা আল্লাহ্র হাবীবের এ ধরাধামে আবির্ভূত হওয়ার স্মৃতিময় দিনটির চেয়ে বেশি আর কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তাঁরই শুভাগমনের পবিত্র স্মৃতি সানন্দে, সাড়ম্বরে পালিত হলেই শুধু এ অর্থসমূহ সঠিকভাবে প্রয়োগসিদ্ধ হয়। শত্রুই হোক, যদি সে সত্য স্বীকারে অকুণ্ঠ হয়, তবে নবীজির চেয়ে উত্তম, উপকারী, মানবিক, দয়ালু, সর্ববিষয়ে পারদর্শী, সৃষ্টিতে সর্বোত্তম, নির্মল চরিত্রের সুন্দর আকৃতির, সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ, সর্বগুণে গুণান্বিত, সম্পূর্ণ কলুষমুক্ত পৃথিবীতে আর কেউ নেইÑতা স্বীকার করতে বাধ্য হবে। মানবতার মুক্তিদাতার পবিত্র জন্মলগ্নের চেয়ে বেশি খুশির দিন আর হতে পারে না। অর্থাৎ মীলাদুন্নবীর দিন। জশনে জুলুস পালনে গৃহীত কর্মসূচিগুলো শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ নয় কোনোটি বরং শুভ উপলক্ষে উত্তম কর্মসূচি। আল্লাহÑরাসূল, দ্বীনÑধর্মের পবিত্র মর্যাদাকে সমুন্নত করে, এমন প্রত্যেক কর্মসূচি অবশ্যই উত্তম। কাজটির উত্তম হওয়া, না হওয়া বিবেচিত হবে এর লক্ষ্যÑউদ্দেশ্যের ভিত্তিতে। নবীজির শানÑমানÑমর্যাদার ঝা-া উত্তোলন করছে জশনে জুলুস। এ লক্ষ্যের সাথে দ্বিমত করবে শুধুই ইবলীস। বাকি সৃষ্টির অণুÑপরমাণু নবী, পাওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল। মর্ত্যবাসী উল্লাস যে অবর্ণনীয়। তাই প্রিয় কবি নজরুলের গযলের কয়েকটি কলি শুনতে মনে হয়, তিনি এ দৃশ্যটিই কল্পনা করে লিখেছিলেন, অর্থাৎ তাঁর পঙক্তিগুলো জশনে জুলুসের জন্য নিবেদিত, ‘ধুলির ধরা বেহেশতে আজ/জয় করিল দিল রে লাজ, আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়। আজকে যত পাপীÑতাপী/সব গুনাহের পেল মাফি/ দুনিয়া হতে বেÑইনসাফী, জুলুম নিল বিদায়॥
দলে দলে সমবেত হওয়া অবৈধ কি? সুরা নাস্র এ আছে, ‘আপনি দেখবেন যে, লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করবে’। মহানবী (দ.) মদীনা পাক হতে হযরত আবু বকর (রাদ্বি.) কে ‘আমীর’ নিযুক্ত করে ‘প্রথম হজ্বের কাফেলা পাঠিয়েছিলেন। কাফেলা দলবদ্ধ জনগোষ্ঠীকেই বলা হয়। সুরা যুমার’র ৭২-৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, জান্নাতী ও জাহান্নামীদের দলে দলে যথাক্রমে জান্নাতে ও জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যারা দলে দলে নবীজির গুণগান করতে থাকে, তারা ওভাবে জান্নাতে যাবেন।
আলোকসজ্জা, কালেমাÑদরুদ খচিত ব্যানার ইত্যাদি শুধু জুলুসের বেলাতেই না জায়েয? খোদ কা’বার গিলাফেও ক্যালিগ্রাফি করা, মনোমুগ্ধকর রূপে খচিত আয়াত কালেমা নিন্দুকদের কারো চোখে পড়েনি কি? নেকÑনিয়তে বৈধ বিষয়াদির আমল গর্হিত তো নয়, বরং পুণ্যময়। তাই, জুলুসে ব্যানারÑ পোস্টার ব্যবহারও অবৈধ হতে পারে না। জুলুসে আগত ভাইদের জন্য কিছু তাবাররুক পরিবেশন, শুভেচ্ছার বিনিময় পুণ্যের কাজ। ‘ইত্ব আÑমুত্তা আমি মিনাল ঈমান। কাজটি ঈমান সম্পৃক্ত। কবরের প্রশ্নোত্তরে সফলকাম হলে কবরও আলোকসজ্জিত হবে।
জুলুস’র প্রত্যেকটি কর্মসূচি যেহেতু পুণ্যধর্মী, উপরন্তু তা আল্লাহ্র রাসূলের জন্য নিবেদিত। তাই, পবিত্র কুরআনÑহাদীসের আলোকে প্রিয় নবীর শুভাগমনের আনন্দে এ উৎসবের কর্মসূচি গৃহিত বিধায় এ উৎসব আমাদের সমুদয় সঞ্চিত পুণ্য আমল থেকে শ্রেষ্ঠ এক পুণ্যময় আমল।

লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব :হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।