করোনায় মৃত্যুর মিছিল

3D illustration of Coronavirus, virus which causes SARS and MERS, Middle East Respiratory Syndrome

চিকিৎসক, সিডিএ কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তা ও আইনজীবীর মৃত্যু#
সুপ্রভাত রিপোর্ট :
মহামারি করোনা একের পর এক কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। চট্টগ্রামে প্রথমবারের মত একজন চিকিৎসক প্রাণ হারালেন করোনায়। করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেন সিডিএ’র একজন পরিকল্পনা কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম থেকে জ¦র নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হলো কাস্টমস কর্মকর্তার। এদিকে এক তরুণ আইনজীবীও মারা গেলেন করোনা উপসর্গ নিয়ে। এছাড়া সাতাকানিয়ায় মারা গেছেন আরেকজন আইনজীবী।
চট্টগ্রামে করোনায় প্রথমবারের মতো চিকিৎসকের মৃত্যু
চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রথমবারের মতো একজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। গত পাঁচদিন আগে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এহসানুল করিমের করোনা শনাক্ত হয়। তিনি বুধবার দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর মৃত্যুর তথ্যটি নিশ্চিত করেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রামে সংগঠনটির করোনা সেলের প্রধান ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ডা. এহসানুল করিম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া চট্টগ্রামের প্রথম ডাক্তার। তবে তিনি এক মাস আগে থেকে ব্লাড ক্যান্সারেও ভুগছিলেন। সর্বশেষ পাঁচদিন আগে তার করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। এরপর থেকেই তাকে চমেকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে নেওয়ার পথে মারা যান।’
তিনি বলেন, ‘ডা. এহসানুল করিম মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রায় ৬০ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎকরা একে একে যখন হাসপাতালে ও চেম্বারে সেবা বন্ধ রেখেছেন, তখন মানবতার এই ফেরিওয়ালা চেম্বার খোলা রেখে রোগীদের সেবা দিয়ে আসছিলেন।
উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেন সিডিএ’র নগর পরিকল্পনাবিদ
করোনা উপসর্গ নিয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নগর পরিকল্পনাবিদ সারোয়ার উদ্দিন আহমেদ। বুধবার বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। খবরটি নিশ্চিত করেছেন তার ছোটো ভাই রায়হান।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে সুপ্রভাতের প্রতিবেদককে সারোয়ার উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, কোথাও তো সিট খালি পাচ্ছি না। তবে ম্যাক্সে এসেছি দেখি কী হয়।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শ্বাস কষ্ট বেশি হওয়ায় ম্যাক্স কর্তৃপক্ষ তাকে জেনারেল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে আইসিইউতে ভর্তি হন। ভর্তির পর বুধবার বিকেল ৪টা ১৫ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উনার লাশ গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে দাফন করা হবে।
উল্লেখ্য, সারোয়ার উদ্দিন আহমেদ কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি দীর্ঘ চাকরিজীবনে সিডিএতে কাজ করেন। মধ্যবর্তী কয়েকবছরের জন্য কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বদলি হয়েছিলেন।
প্লাজমা দিয়েও বাঁচানো গেল না কাস্টমস কর্মকর্তাকে
করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) জসিম উদ্দিন মজুমদার (৫৫) মারা গেছেন। তিনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রায় এক সপ্তাহ অসুস্থতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরে গত ১৮ মে জ্বর নিয়ে তিনি চিকিৎসার জন্য ঢাকা চলে যান। ওইদিনই তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। করোনার উপসর্গ থাকায় তার নমুনা পরীক্ষা করোনা হয়। পরে নমুনা পজেটিভ আসে। ১৮ ও ১৯ মে তিনি ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বুধবার (৩ জুন) রাত ২টা ৫ মিনিটে রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এবং মূসক, নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘জসিম উদ্দিন মজুমদারের চিকিৎসায় তার সহকর্মী ও অ্যাসোসিয়েশন থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়ং। সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি মারা যান। করোনা মহামারিতে রাজস্ব আহরণ ও রাজস্ব সেবা প্রদানের মতো রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রথম একজন রাজস্ব কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে। তার স্ত্রীও করোনা পজেটিভ। সন্তানরাও আক্রান্ত হতে পারেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘জসিম উদ্দিন মজুমদার আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা, ডায়াবেটিসসহ নানান রোগে ভুগছিলেন। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রায় এক সপ্তাহ অসুস্থতা নিয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি আরো বলেন, ‘ইউনাইটেডে করোনার ভালো চিকিৎসা না থাকায় ২০ মে তাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তার রক্তচাপ, ডায়াবেটিক ও অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে শ্বাসকষ্ট বেয়ে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শে ও বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তায় ২১ মে তাকে রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেও তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তায় করোনার জন্য তিন ব্যাগ প্লাজমাও দেওয়া হয়।’
এনবিআর সূত্র জানায়, জসিম উদ্দিন মজুমদার ফেনীতে ১৯৬৫ সালের ১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। ২০০৪ সালের ৫ ডিসেম্বর চাকরিতে যোগদান করেন। তিনি মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ (মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ছেলে স্ট্যান্ডার্ড সেভেন) অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ফেনীর শান্তি কোম্পানি রোডের মজুমদার বাড়িতেই তাঁর দাফন সম্পন্ন হবে।
শিক্ষানবিশ আইনজীবীর মৃত্যু
করোনার উপসর্গ নিয়ে মারুফ চৌধুরী নামে শিক্ষানবিশ আইনজীবী বুধবার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
বরকত উল্লাহ খান নামে এক আইনজীবী গণমাধ্যমকে জানান, করোনার উপসর্গ নিয়ে চমেকে ভর্তি হয়ে হঠাৎ মারা যান মারুফ। তিনি গত ২৫ মার্চ শেষবার আদালতে এসেছিলেন। মাত্র ১০দিন আগে তার কন্যাসন্তান হয়েছে।
তার মৃত্যুতে আইনজীবীরা শোক জানিয়েছেন।
আইনজীবীর মৃত্যু সাতকানিয়ার
সাতকানিয়ায় জ্বর আর প্রচ- শ্বাস কষ্ট নিয়ে এক আইনজীবী মারা গেছেন। মৃত্যুবরণকারী আইনজীবীর নাম মাহবুবুল হক (৬২)। তিনি সাতকানিয়া আদালতে সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। আমাদের সাতকানিয়া প্রতিনিধি জানান, অ্যাডভোকেট মাহবুব উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড গারাংগিয়া মুন্সি মাঝির পাড়া এলাকার মৃত মাওলানা এজহারুল হকের ছেলে। সাতকানিয়া আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুবাদে তিনি মারা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পৌর সদরের সতিপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবার পরিজন নিয়ে অবস্থান করতেন। আইনজীবী মাহবুবুল হকের ২ মেয়ে ১ ছেলে রয়েছে।
সাতকানিয়া আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী কচির জানান, গত মঙ্গলবার সতি পাড়া ভাড়া বাসায় মাহবুবুল হকের শরীরে জ্বরসহ শ্বাস কষ্ট শুরু হলে তাকে চট্টগ্রাম মহানগরের পার্ক ভিউ বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তার বুকের এক্সরে করেন। এক্সরে রিপোর্ট ভাল না হওয়ায় পার্ক ভিউ’র চিকিৎসকরা তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে রাত সাড়ে ৯টার সময় মাহবুবুল হক মৃত্যুবরণ করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন সাতকানিয়া আদালতে কর্মরত আইনজীবী হাফিজুর রহমান মানিক ও সোনাকানিয়া ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুর রহিম।
তারা বলেন, মাহবুবল হক করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেও তার নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি। রিপোর্ট পাওয়ার তিনি করোনা বা কোভিড-১৯ আক্রান্ত ছিলেন কিনা নিশ্চিত করে বলা যাবে ।
যোগাযোগ করা হলে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবদুল মজিদ ওসমানী বলেন, রাতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধর্মীয় আনুষ্ঠিকতার মাধ্যমে মাহবুবুল হককে পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয়।