ইন্ডিয়া-বার্মা প্লেট বাউন্ডারি : ৬ বছরে ২০০ ভূমিকম্প

ঘন ঘন ভূমিকম্পে মাটির অভ্যন্তরের শক্তি বের হয়ে যায়, যা আগামীতে বড়

ভূমিকম্পকে বিলম্বিত করে : বিশেষজ্ঞদের মত

ভূঁইয়া নজরুল :>

ছোটো ছোটো ভূমিকম্প কখনো আর্শীবাদ হয়, আবারো কখনো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হয়। ভূমিকম্প গবেষণায় উভয় যুক্তি সত্যি। কখনো একটি ঘটে, আবার কখনো আরেকটি ঘটে। ভারত-মিয়ানমার সীমানেত্ম (পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বে) গত ৬ বছরে বিভিন্ন মাত্রার ২০০ ভূমিকম্প রেকর্ড করেছে ভূমিকম্প বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআরএস (ইনকরপোরেটের রিসার্চ ইনস্টিটিউশন ফর সিসমোলজি)। চট্টগ্রাম থেকে এই সীমানেত্মর দূরত্ব ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে। কম দূরত্ব হওয়ার কারণে তা চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য ভাবনার বিষয়। তবে এসব ভূমিকম্প কি এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় দেশের ভূ-কম্পন বিশারদদের সাথে। তাদের কথায়ও বিভক্তির সুর। এবিষয়ে দেশের অন্যতম ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড.মেহেদী আনসারী বলেন,‘ ছোটো ছোটো ভূমিকম্প কখনো কখনো মাটির অভ্যন্তরে সৃষ্ট হওয়া শক্তিগুলোকে বের করে দেয়, আর এতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার জন্য শক্তি হারিয়ে ফেলে। আর একারণে শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে ২০০ বা ২৫০ বছর সময় নিয়ে থাকে।’

তিনি আরো বলেন, ১৭৬২ সালে কক্সবাজারের নিচে এবং ১৮৫৭ সালে আসামের দিকে দুটো শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই হিসেবে গণনা করলে এখন এই অঞ্চলে একটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে।

কিন’ গত কয়েকবছর ধরে এই অঞ্চলে যে অনেক ভূমিকম্প হচ্ছে এর কি হবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতে হয়তো শক্তি বের হয়ে যাচ্ছে এবং শক্তিশালী ভূমিকম্প নাও হতে পারে। মাটির নিচের কোনো বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণার ফলাফল পাওয়া যায়নি।

একই মন্তব্য করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্পবিদ মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম বলেন,‘ ২০১৬ সালের জানুয়ারি, এপ্রিল ও আগস্টে ৬ দশমিক ৬, ৭ দশমিক ২ ও  থেকে ৬ দশমিক ৮ রিকটার স্কেলের তিনটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের পর গত কয়েক বছর বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প এই এলাকায় হয়নি। এখন আবার ভূমিকম্প হচ্ছে। গত এপ্রিলে ৫ দশমিক ৯ এর পর গতকাল ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে ৫ দশমিক ৮ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্প হয়েছে একই এলাকায়। এর আগে গত রোববার বিকেলে ৫ দশমিক ১ রিকটার স্কেলের আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছিল একই এলাকায়। পরপর দুটি ভূমিকম্প হলো।‘

আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই

বাংলাদেশের পূর্ব পাশ দিয়ে ফল্ট লাইন ও পেস্নট বাউন্ডারি যেহেতু গিয়েছে তাই এলাকাটি ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যায়িত করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্পবিদ মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম বলেন,‘ ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এই এলাকায় গত কয়েক বছর ধরেই অনেকগুলো ভূমিকম্প হয়েছে। আর মাঝারি মাত্রার এসব ভূমিকম্পের কারণে মাটির অভ্যন্তরের শক্তি বের হয়ে এলে হয়তো শক্তিশালী ভূমিকম্প নাও হতে পারে। তাই ভেতরের শক্তিগুলো মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের মাধ্যমে বের হয়ে আসায় ভাল হচ্ছে।’

একই মন্তব্য করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া মোহাম্মদ মোহসিন। তিনি বলেন,‘ বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ এলাকা ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তা আমরা জানি। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো হয়ে যাওয়ায় হয়তো বড় ভূমিকম্পের জন্য শক্তিসঞ্চয় করতে আরো সময় পাওয়া যাবে।’

স্বাভাবিক ভাবেই ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চল

চট্টগ্রাম ও সিলেট স্বাভাবিকভাবেই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে উলেস্নখ করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মমিনুল হক বলেন,‘ বাংলাদেশ মিয়ানমার (বার্মা) সীমানেত্মর পাশ দিয়ে একটি ফল্ট লাইন রয়েছে। আর এই ফল্ট লাইনটি আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত এবং বাংলাদেশ ভারত সীমানেত্মর ত্রিপুরা, বিহার, মেঘালয়, শিলং হয়ে হিমালয়ান পর্বতমালা পর্যন্ত বিসত্মৃত। এই এলাকায় ভূমিকম্প বেশি উৎপত্তি হয়ে থাকে এবং তা আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের পূর্ব পাশ দিয়ে ইন্দো-অস্ট্রেলিয়া পেস্নট বাউন্ডারি ও বার্মায় একটি ছোটো পেস্নট বাউন্ডারি রয়েছে। বর্তমান সময়ে যেসব ভূমিকম্প উৎপত্তি লাভ করছে সেই পেস্নট বাউন্ডারি বরাবর। তাই চট্টগ্রাম ও সিলেট জোন অনেকটা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে।

প্রস্তুতি কেমন আছে?

দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মোহসিন বলেন,‘ ভূমিকম্প দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সরকারের পড়্গ থেকে নতুন বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হচ্ছে। একইসাথে সারাদেশে মাটির গঠন কাঠামো কেমন তা জানতে জাপানের সহায়তায় একটি গবেষণা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পথে। এই গবেষণা শেষ হলে কোন এলাকায় কত উচ্চতার কিংবা কোন ধরনের কাঠামোর ভবন করা যাবে সেবিষয়ে একটি গাইডলাইন পাওয়া যাবে।’

তিনি আরো বলেন, একইসাথে আমাদের জনগণকেও সচেতন হবে। সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণে তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।

সারবিশ্বে প্রতিবছর দুই হাজার বার ভূমিকম্প হয়। এদের মধ্যে বছরে ১০০ ভূমিকম্প তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হয়ে থাকে। ছোটো-বড় ২৭টি পেস্নট নিয়ে গঠিত পৃথিবী প্রতিনিয়ত গতিতে থাকার কারণে পস্নটগুলোর প্রান্তসীমায় ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। ইন্ডিয়া ও বার্মা পেস্নটের মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণেই টেকনাফ থেকে হিমালয়ান পর্বতমালা পর্যন্ত গঠিত হয়েছিল হিমালয় পর্বতমালা। এদিকে গত ১৬ এপ্রিল ৫ দশমিক ৯ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্পের পর, গত রোববার বিকেলে ৫ দশমিক ১, সোমবার ভোর রাতে ৫ দশমিক ৮ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্প হয়েছে একই এলাকায় ( ভারত মিয়ানমার সীমানেত্মর মিজোরাম এলাকায়)। এসব ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কম্পন অনুভূত হয়েছে। এতে এই এলাকার মানুষের মধ্যে ভূমিকম্প আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।