‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড়ের আভাস

সাগরে গভীর নিম্নচাপ

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত নি¤œচাপটি আরও ঘনীভূত হয়ে পরিণত হয়েছে গভীর নিম্নচাপে, যা ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পেতে পারে বলে আভাস দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিলে তখন এর নাম হবে ‘মোখা’। এটি ইয়েমেনের দেওয়া নাম। খবর বিডিনিউজের।

আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, গভীর নিম্নচাপটি বুধবার সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১৫৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১৪৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৫৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্বে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৫০৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ছিল ৫০ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের কাছে সাগর উত্তাল থাকায় দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে এবং গভীর সাগরে বিচরণ না করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছেন, গভীর নিম্নচাপটি আরও ঘনীভূত হয়ে ১১ মে পর্যন্ত উত্তর উত্তর পশ্চিম দিকে এবং পরবর্তীতে দিক পরিবর্তন করে ক্রমান্বয়ে উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে।

গ্লোবাল ফোরকাস্ট সিস্টেম বা জিএফএস এর পূর্বাভাস মডেলের ভিত্তিতে বঙ্গোপসাগরে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের এই গতিপথের আভাস দিয়েছে ট্রপিকাল টিডবিটস ডটকম। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই পূর্বাভাসে এবং গতিপথে পরিবর্তন আসতে পারে।

সম্ভাব্য গতিপথ
ভারতীয় আবহাওয়া অফিস বলছে, দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গোপসাগরের বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলার পথে আরও শক্তি সঞ্চয় করবে।
এরপর আরও উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিকে এগিয়ে এ ঘূর্ণিঝড় বৃহস্পতিবার দুপুর নাগাদ পরিণত হতে পারে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। এ ঝড় আরও শক্তিশালী হয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত নাগাদ অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পেতে পারে।

এরপর দক্ষিণপূর্ব বঙ্গোপসাগরের ওই অবস্থান থেকে ঝড়টি ধীর ধীরে বাঁক নিতে শুরু করবে এবং উত্তর উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে।
ভারতীয় আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যে অনুমান তারা করছেন, তা ঠিক থাকলে ১৪ মে দুপুর নাগাদ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আকারে মোখা বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

অবশ্য ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পর কোনো পর্যায়ে এর গতিপথ পাল্টে গেলে উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাব্য স্থানও বদলে যেতে পারে।

মোখার উন্মেষ পর্ব
বাংলাদেশের স্থলভাগে তাপপ্রবাহ বয়ে চলার মধ্যে সোমবার দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগর ও এর সংলগ্ন আন্দামান সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়।তখন থেকে এর আরও ঘনীভূত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। মঙ্গলবার এটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে বাতাসের বেগ দাঁড়ায় ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার। বাতাসের গতিবেগ ৮৯ থেকে ১১৭ কিলোমিটার হলে তাকে বলে প্রবল ঘূর্ণিঝড়, গতিবেগ বেড়ে ১৮০ থেকে ২১৯ কিলোমিটার হলে তাকে হারিকেনের গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় বলে, আর তার চেয়ে বেশি গতিবেগ হলে তাকে সুপার স্লাইকোন বলা হয়।

ঝড়-জ্বলোচ্ছ্বাসপ্রবণ বাংলাদেশে মূলত এপ্রিল-মে এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ সময়ে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝড় ও প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়ে থাকে।

আবার ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিধসের ঝুঁকিও তৈরি হয়। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যানদাউস’ ভারতের তামিলনাড়ু ও পুদুচেরি উপকূলে আঘাত হানার পর দুর্বল হয়ে পড়েছিল, এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি।

ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কায় সব আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার নির্দেশ
সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সব দিক থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ উপকূলীয় এলাকায় যত আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে, তার সবগুলো প্রস্তুত রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার বিকালে সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় কমিটির সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ নির্দেশনার কথা জানান।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সব দিক থেকে প্রস্তুত রয়েছি। প্রতিবারের মত এবারও আমরা সফলভাবে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করতে সক্ষম হব।’ স্থলভাগে তাপপ্রবাহ বয়ে চলার মধ্যে সোমবার দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগর ও এর সংলগ্ন আন্দামান সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়, যা ধাপে ধাপে শক্তিশালী হয়ে গভীর নি¤œচাপে পরিণত হয়েছে। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে বুধবারই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পেতে পারে; তখন এর নাম হবে ‘মোখা’ (গড়পযধ) ।

বর্তমান গতি প্রকৃতি অনুযায়ী এগোলে বা দিক না পাল্টালে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোখা ১৪ মে বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে সচিবালয়ে সমন্বয় সভায় বসেন প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের গতি প্রকৃতি ও অবস্থান নিয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পর্যালোচনা তথ্য তুলে ধরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ১৩ মে সন্ধ্যা থেকে ১৪ মে সকালের মধ্যে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখেছি- বাংলাদেশ উপকূল থেকে গড়ে ১৫০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছে। ১২ মে নাগাদ এটি উত্তর পূর্ব দিকে বাঁক নেবে এবং কক্সবাজার জেলা ও মিয়ানমার উপকূল দিয়ে আঘাত হানবে। আঘাতের সময় বাতাসের বেগ ১৮০-২২০ কিলোমিটার থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এসওডি (স্থায়ী আদেশবালী) অনুযায়ী সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানান এনামুর রহমান।

তিনি বলেন, এ পূর্বাভাস অনুযায়ী মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি। সভায় মুখ্য সচিব রয়েছেন, সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের পিএসও এর সঙ্গে বলেছি। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি-সিপিপিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আগাম সতর্কবার্তা প্রচারের জন্য।

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ উপকূলীয় এলাকার সব আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘উপজেলার শেল্টার প্রিপারেশন কমপ্লিট। সেখানে ১৪ টন শুকনো খাবার ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। আগামীকালের মধ্যে ২০০ টন চাল চলে যাবে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছি শেল্টার ম্যানেজমেন্টর জন্য।’

ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা কাজ করবে বলে জানান তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ পরিবহন, জনবল ও লোকজন আনা নেওয়ায় সহায়তা করে আসছে। লোকজনকে জোর করে আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে পুলিশ সহায়তা করে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, আনসার, কোস্টগার্ড প্রস্তুত রয়েছে।

ইতোমধ্যে সমুদ্রবন্দরগুলোকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।সব মাছ ধরার নৌযানকে গভীর সাগরে না যাওয়ার পাশাপাশি যারা গভীর সমুদ্রে রয়েছে, তাদের ফিরে আসতে বলা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে ক্ষয়ক্ষতি ও জনমালের ক্ষতি শূন্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব।ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ফায়ার সার্ভিসও বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েছে।এক সংক্ষিপ্ত বার্তায় ফায়ার সার্ভিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে তাদের ১৪৯টি ফায়ার স্টেশন প্রস্তুত রয়েছে। সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘সতর্ক ডিউটি’তে রাখা হয়েছে।

পাকা ফসল দ্রুত ঘরে তোলার পরামর্শ
ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় পরিপক্ক ধানসহ অন্যান্য ফসল দ্রুত ঘরে তোলার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতর। প্রতিষ্ঠানের সরেজমিন উইং থেকে সম্প্রতি বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

দেশে বোরো ধান ঘরে তোলার মৌসুম চলছে। রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় পরিপক্ক হয়ে উঠেছে আম, পাকতে শুরু করেছে লিচুও। ঘূর্ণিঝড় মোখা দেশে আঘাত হানলে বোরো ধানসহ বেশ কিছু ফসলের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে এই পরামর্শ দেওয়া হয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশের হাওর অঞ্চলের শতভাগ বোরো ধান কাটা এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। সারাদেশেও ৬০ ভাগের বেশি বোরো ধান কাটা শেষ।
তথ্যমতে, অন্যান্য বেশ কয়েক বছরের মধ্যে এবার হাওরে বোরো ধানের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আকস্মিক বন্যায় প্রায় প্রতিবছরই হাওরে বোরো ধানের ক্ষতি হয়ে থাকে। তবে সারাদেশে এখনও বোরো ধান কাটা শেষ হয়নি, তাই বোরো নিয়ে এখনও শঙ্কা রয়ে গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, ৮০ শতাংশ পাকা ধান, পরিপক্ক আম ও অন্যান্য ‘সংগ্রহ উপযোগী’ ফসল দ্রুত সংগ্রহ করতে কৃষকদের অনুরোধ জানিয়েছে। পাশাপাশি, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতামূলক তথ্য মাঠে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সার্বক্ষণিক কর্মস্থলে থেকে কৃষকদের পরামর্শ দিতে কৃষকের পাশে থাকতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে।