সুপ্রভাত ডেস্ক »
খুচরা বাজারে শুক্রবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অনেকে বোতলজাত সয়াবিন কিনে তা ভেঙে খোলা হিসেবে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট কমানোর পর কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসা ভোজ্যতেলের বাজার আবার অস্থির হয়ে গেছে ইন্দোনেশিয়ার পাম তেল রপ্তানি নিষিদ্ধের খবরে। দোকান থেকে উধাও হয়ে গেছে বোতলজাত সয়াবিন তেল। খোলা মিললেও এক লিটার বিক্রি হচ্ছে নির্ধারিত দরের চেয়ে ৫০ টাকার বেশিতে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সপ্তাহখানেক ধরে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার পর দুই দিন থেকে খুচরা বাজারে তেল সরবরাহই বন্ধ রয়েছে। এতে বাজার থেকে অনেকটাই উধাও এ নিত্যপণ্য।
আরেক দফা দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের পূর্বপাশে বেশ কয়েকটি মুদি দোকান রয়েছে। অন্য সময় সবগুলো দোকানের সমনে এক থেকে ৫ লিটারের বোতল সারি করে সাজিয়ে রাখা হয়। কিন্তু শুক্রবার দোকানগুলোর সামনে কোনো বোতলের দেখা মিলল না। তার জায়গা দখল করে রেখেছে সেমাই, চিনি ও অন্যান্য ঈদসামগ্রী।
তেলের লিটার কত জানতে চাইলে বাশার এন্টারপ্রাইজের মালিক আবুল বাশার বলেন, ‘পাঁচ-সাত দিন ধইরা কোনো কোম্পানি ঠিকমতো তেল দিচ্ছে না। তিন দিন ধইরা একেবারেই বন্ধ। তেল না থাকায় অন্য মালও বেচতে পারতেছি না।
‘বড় দোকানদাররা হয়তো কিছু স্টক রাখছিল, সেগুলো এখন বেচতাছে। আমরা ছোট দোকানদার। মাল আনি আর বেচি। স্টকও নাই, বেচাও নাই। কাস্টমার এক দোকান থেইকা সব কিনতে চায়। এক মাল না পাইলে অন্যগুলোও নেয় না।’
তেল আছে কিনা জানতে চাইলে বিসমিল্লাহ ট্রেডিংয়ের বিক্রয়কর্মী আবদুর রহমান বলেন, ‘তেল নিয়ে যে কী হইতাছে, কিছুই বুঝতেছি না। দু-তিন দিন ধইরা তেল পাইতেছি না। কাস্টমার আইসা ফিরা যায়। আমরা তেল মজুত করতে পারতেছি না।
‘পাশেই মার্কেটের দোতলায় তেল হোলসেল করা হয়। কাস্টমারের যেমন চাহিদা থাকে তেমন আনি আর বিক্রি করি। দুই দিন ধইরা খোলা তেল আনার জন্য লোক পাঠাইয়াও পুরো বাজারে পাই নাই। এমনকি এক লিটার বোতলের তেলও পাই নাই।’
নিজের বাসার জন্য আট-দশ দোকান খুঁজে এক লিটার তেল কিনেছেন বলে জানালেন তিনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘অথচ আমরা শুনছি দোতলার গোডাউনগুলা ভরা। কিন্তু তেল বাজারে ছাড়তাছে না। স্টক কম দেখায়া দাম আবার বাড়ানোর চিন্তা। তেল ব্যবসায়ীরা গত এক বছরে যে টাকা কামাই করতাছে গত ১০ বছরেও এত কামাই করছে কি না আমার সন্দেহ।’
এ দোকানি বলেন, ‘তেল কোম্পানিগুলো একেকবার একেক ফন্দি করে। এর আগে তীর কোম্পানি শর্ত দিছিল তিন কার্টন সয়াবিন তেল নিলে এক কার্টন সরিষার তেল নিতে হবে। এক কার্টনে ১৮ লিটার তেল। আবার প্রতি লিটার সরিষার তেল ৩১০ টাকা। এত দাম দিয়া কে কিনবে? তাই পাইলে তেল বেচি না পাইলে বেচি না।’
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরেই অস্থির তেলের বাজার। দেশের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখতে তিন পর্যায়ে ৩০ শতাংশ ভ্যাট মওকুফের সুবিধা দিয়েছে সরকার। যা ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে।
কর ছাড়ের পর লিটারপ্রতি দাম কিছুটা কমানো হয়েছিল। আর রোজার আগে আগে এই পদক্ষেপে কিছুদিন সরবরাহ ছিল স্থিতিশীল। তবে হঠাৎ করেই বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন অনিশ্চয়তা। পাম অয়েলের বড় সরবরাহকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া এরই মধ্যে তেল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এরপর থেকেই দেশের বাজারে নতুন অস্থিরতার শুরু।
কারওয়ান বাজারে ভিড়ে হঠাৎ দেখা গেল একজন ৫ লিটারের তেলের বোতল নিয়ে যাচ্ছেন। নাম সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘১০-১২ দোকান ঘুরে এক দোকানে তেল পাইছি। তবে দাম বেশি রাখে নাই ৮০০ টাকাই নিচে। তাও যে তেল পাইছি এটাই অনেক। কিন্তু তেল নাই কেন বুঝলাম না। সরকার তো ট্যাক্স কমাইছে। কইছে, অনেক তেল আসতাছে। তাহলে তেল থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই দাম বাড়ানোর ফন্দি।’ খবর নিউজবাংলার।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই তেলের বাজারে কারসাজি চলছে। এ জন্য আমরা বাজার তদারকি চালিয়ে দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। তবে সমস্যা তো সব পণ্যেই রয়েছে। তাই আমরা যেই অন্য পণ্যের দিকে নজর দিয়েছি, সেই সুযোগে ভোজ্যতেলের বাজারে আবারও অস্থিরতার পাঁয়তারা চলছে। আমরা আবারও তেলের বাজার তদারকি শুরু করব।’
রাজধানীর অন্যান্য বাজারে তেলের সংকট চলছে। সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের আল আমিন স্টোরের মালিক মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে তেল আনা বন্ধ। এক লিটার, দুই লিটার, পাঁচ লিটার কোনো মালই পাইতেছি না। কয়দিন ধরে দোকানে সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ।’
পাশের দোকানের বিক্রেতা তারেক বলেন, ‘১০ দিন আগে বসুন্ধরা ও তীর কোম্পানি কিছু মাল দিয়েছিল। তাও শর্ত ছিল তাদের ব্যান্ডের হালিম মিক্স, চা পাতা, মসলা কিনতে হবে। যেগুলো খুব একটা চলে না। এখন দোকানে ২ লিটারের দুইটা বোতল আর এক লিটারের একটা বোতল আছে।’
এদিকে খুচরা বাজারে শুক্রবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অনেকে বোতলজাত সয়াবিন কিনে তা ভেঙে খোলা হিসাবে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, এক বছরের ব্যবধানে তেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। আর মাসের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
সংস্থাটির হিসাবে এক বছর আগে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলে ছিল ১২০ টাকার মতো, এক মাস আগে ছিল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮৪ থেকে ১৮৬ টাকায়। বছরের ব্যবধানে ৫০ শতাংশ এবং মাসের ব্যবধানে দাম ২৫.৪২ শতাংশ বেড়েছে।
এক বছর আগের ১০৬-১১০ টাকার খোলা পাম অয়েল এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১৩১ থেকে ১৩৬ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায়। বছরের ৫৫ শতাংশ এবং মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ২৫.৪৭ শতাংশ।
পাম অয়েল সুপার এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬৭ থেকে ১৭২ টাকায়, যা এক বছর আগেও ছিল ১০৫ থেকে ১১০ টাকা। এক মাস আগে যা ছিল ১৪০ থেকে ১৪৪ টাকা। বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ আর মাসের ব্যবধানে ১৯.৩৭ শতাংশ।
আর বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম এক বছর আগে ছিল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। এক মাস আগে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায়।