মুহাম্মদ আবুল মনছুর »
আল্লাহর পরম নৈকট্য লাভের অধিকারী হওয়ার একমাত্র গৌরব অর্জনকারী সৃষ্টির সেরা জীব মানব। এ মানব যখন সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ থেকে দূরে সরে গিয়ে এ নশ^র পৃথিবীর মায়াজালে আক্রান্ত, ঠিক তখনি তাদের উদ্ধারে মহান আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে তাঁর প্রিয় বান্দাদের তথা নবী, রাসুল, অলি বুজুর্গানে দ্বীন ও হাদিগণকে পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর এক যুগ সন্ধিক্ষণে ফটিকছড়ির থানার অন্তর্গত মাইজভান্ডার গ্রামে ১২৪৪ হিজরি মোতাবেক ১২৩৩ বাংলা, ১৮২৬ ইংরেজি, ১১৮৮ মঘীর ১লা মাঘ বুধবার সৈয়দ আহমদ উল্লাহ প্রখ্যাত সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ মতিউল্লাহ এবং মাতার নাম বিবি খায়রুনেছা।
গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হযরত শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) স্থানীয় মক্তবে লেখাপড়া শেষে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১২৬০ হিজরি সনে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে ইলমে শরিয়তের প্রতিটি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন এবং ১২৬৮ হিজরি সনে কৃতিত্বের সাথে মাদ্রাসা আলিয়ার শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর ১২৬৯ হিজরি সনে যশোরে কাজী পদে যোগদান করেন। মাত্র ১ বছর চাকরি করে ১২৭০ হিজরি সনে কলকাতা মুন্সী বুঁ আলী সাহেবের মাদ্রাসায় এবং পরে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন। সেখানে কাদেরিয়া তরিকতের শায়খ গাউছে কাউনাইন আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ কাদেরী লাহুরীর (রহ.) হাতে বায়াত গ্রহণ করে গাউসিয়ত লাভ করেন এবং কুতবুল আকতাব দেলোয়ার আলী পাকবাজ (রহ.) এর সান্নিধ্যে কুতুবিয়তের ফয়জ লাভে ধন্য হন।
তিনি তিন বছর স্বীয় পীরের খেদমতে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। এরপর পীরের নির্দেশ ১২৭৫ হিজরিতে হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী নিজ দেশে ফিরে আসেন এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে আপামর জনগণকে প্রভুর প্রেম ভালবাসার দীক্ষা দিতে লাগলেন।
১২৭৫-১৩২৩ হিজরি পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৮ বছর হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (ক.) ‘মাইজভান্ডারী তরিকা’ প্রবর্তনের মাধ্যমে ‘বেলায়তে মোতলাকা’ প্রজ্ঞাময় আহ্বানে মানব ও মানবতার কল্যাণ সাধন করে মানবজাতিকে সকল ধর্মীয় এখতেলাফ, গোঁড়ামী, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি ইত্যাদি পরিহার করে মহান খোদার নৈকট্যের পথকে সুগম করেন ।
তিনি সর্বজনীন হিসেবে অনুরাগী বা বিরাগী প্রত্যেকের জন্য তাঁর তরিকতের অন্যতম শুদ্ধি প্রণালী স্বাভাবিক ও সহজতম কর্মপন্থা হিসেবে উছুলে ছাবয়া বা সপ্তকর্ম পদ্ধতি প্রণয়ন করেন। এর সাহায্যে মানব খোদা পরিচিতি জগতে উন্নীত হয়ে স্রষ্টার সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করে তার সম্বন্ধে এক ‘কাশফী’ নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হন। এ সপ্ত কর্মপদ্ধতিকে তিনি কার্যকরী প্রত্যক্ষ কোরআনী হেদায়ত বলে সাব্যস্ত করেন। যা সকল সম্প্রদায় ও ধর্মাবলম্বীর জন্য নির্বিরোধ ও সহজসাধ্য।
সপ্তকর্ম পদ্ধতি
ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ স্তর:
ক. ফানা আনিল খাল্ক : অর্থাৎ কারো নিকট কোনোরূপ উপকারের আশা বা কামনা না থাকা, যার ফলে মানব মন আত্মনির্ভরশীল হয় এবং নিজ শক্তি সামর্থ্যরে প্রতি আস্থা জন্মে।
খ. ফানা আনিল হাওয়া : অর্থাৎ যা না হলে চলে সেরূপ কাজকর্ম ও কথাবার্তা হতে বিরত থাকা যার ফলে জীবনযাত্রা সহজ ও ঝামেলা মুক্ত হয়।
গ. ফানা আনিল এরাদা : অর্থাৎ খোদার ইচ্ছাশক্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া এবং নিজ ইচ্ছা বা বাসনাকে খোদার ইচ্ছার নিকট বিলীন করা যার ফলে সুফি মতে ‘তসলিম ও রজা’ হাসিল হয়।
মউতে আরবা বা চতুর্বিধ মৃত্যু
ক. মউতে আবয়্যাজ বা সাদা মৃত্যু :
এটা উপবাস এবং সংযমে আয়ত্ত হয়, যার ফলে মানব মনে আলো এবং উজ্জ্বলতা দেখা দেয়। যেমন রমজানের রোজা বা নফল রোজা ইত্যাদি হলো উপবাস ও সংযম পদ্ধতি।
খ. মউতে আছওয়াদ বা কালো মৃত্যু :
এটা শত্রুর শত্রুতা বা নিন্দুকের নিন্দাতে হাছিল হয়।
গ. মউতে আহমর বা লাল মৃত্যু :
এটা কামভাব ও লালসা হতে মুক্তিতে হাসিল হয় এবং বেলায়তপ্রাপ্ত হয়ে অলিয়ে কামেলদের মধ্যে গণ্য হয়।
ঘ. মউতে আখজার বা সবুজ মৃত্যু :
এটা নির্বিলাস জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলেই হাসিল হয়। যার ফলে মানব অন্তরে স্রষ্টার প্রেম ভালবাসা ছাড়া অন্য কামনা বাসনা থাকে না। এটি বেলায়তে খিজরীর অন্তর্গত।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর জিন্দেগী মোবারক ছিল শরিয়ত, তরিকত, মারফত ও হাকিকত দ্বারা পরিপূর্ণ। উল্লেখ্য, হযরত কেবলা সাত বছর বয়স থেকে নামাযের পাবন্দী করতেন এবং জামাতে নামাজ আদায় করতেন। অতিবেশি নফল নামায, কোরআন শরিফ তেলাওয়াত, রোযা পালন ও মোশাহেদা মোরাকাবাতে রত থাকতেন।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (ক.) তাঁর মুরিদান, আশেক ভক্তগণের উদ্দেশে নসিহত করতেন, ফেরেশতা কালেব বনে যাও। অর্থাৎ ফেরেশতার ন্যায় খোদার হুকুম মত কাজ কর, অবাধ্য হয়োনা। কবুতরের মত বেছে খাও। হারাম খেয়ো না, নিজ সন্তান সন্ততি নিয়ে খোদার প্রশংসা করো। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়, সালাতুত তসবীহের নামাজ পড়িও, কোরআন শরিফ তেলোয়াত করিও। কোন কোন সময় আইয়্যামে বীজের রোজা অর্থাৎ চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে উপবাস করে সংযম অবলম্বন করতে বলতেন। এভাবে নফল ইবাদতের দিকে উৎসাহিত করতেন, যাতে মানব পাপ কার্য বিরত হয়ে স্রষ্টাতে মনোনিবেশ করতে অভ্যস্ত হয়।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (ক.) অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি তাঁর সহধর্মিণীকে বলতেন- ‘দুনিয়া মুসাফিরের জায়গা এখানে আড়ম্বরের দরকার কি? হযরত আকদাছ আড়ম্বরমূলক খুশি পছন্দ করতেন না। কেউ শাদী শব্দ উল্লেখ করে বিয়ের অনুমতি প্রার্থনা করলে বলতেন, রসুলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ জগতকে ‘দারুল হাজান’ বলেছেন, তুমি আমাকে খুশি শুনাতে এসেছ!’ দয়ার সাগর হযরত কেবলা হাজতি মকছুদি লোকদের আনা টাকা পয়সা এবং বিভিন্ন সামগ্রী যে যেভাবে চাইতেন দান করে দিতেন।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) নীতি. আদর্শ মানব ও মানবতার কল্যাণের জন্য সময় ও বাস্তব উপযোগী অনুকরণীয় আদর্শিক পন্থা। সর্বজাতি ও সর্ব ধর্মের ধর্মীয় লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার এবং সকলের গ্রহণোপযোগীই সহজতম পন্থা। বর্তমান বিশে^ ধর্মীয় শান্তিসহ সকল ধর্মের বিভেদ মেটানোর জন্য হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) প্রণীত মাইজভাণ্ডারী তরিকার মূলনীতিসমূহ অত্যন্ত কার্যকর ও উপকারী। তাই অছিয়ে গাউছুল আজম, খাদেমুল ফোক্রা হযরত মওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.) বলেছেন, ‘গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর আদর্শ উর্ধ্বে তুলিয়া ধরিলে বিশ^বাসীর চোখ চট্টগ্রাম মাইজভান্ডার দরবার শরিফের দিকে ঘুরিয়া যাইবে।’
মানব কল্যাণ সাধনে তাঁর অজস্র অগণিত কারামতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তিনি এমন এক খোদায়ী প্রদত্ত শ্রেষ্ঠত্ব সম্পন্ন আল্লাহর অলি ছিলেন, জনগণের না হওয়ার মত কাম্য বস্তুকে খোদার ইচ্ছা শক্তিতে তাঁর গাউছে আজমিয়তের প্রভাবে হওয়ার রূপ দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।
হযরত কেবলা (ক.) কালাম করেছেন, ‘রসুলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুটি টুপির মধ্যে একটি টুপি আমার মাথায়, অপরটি আমার ভাই বড় পীর ছাহেবের মাথায় দিয়েছেন।’ ‘আমার নাম পীরানে পীর ছাহেবের নামের সাথে সোনালী অক্ষরে লিখা আছে।’ অর্থাৎ ধর্মে নতুনত্ব দানে শাহে বাগদাদীর অনুরূপ জীবনদাতা। এই কালামগুলি তাঁর গাউছে আজমিয়তের প্রমাণ ও স্বীকৃতি বহন করে।
হযরত শায়খুল আকবর আল্লামা মুহিউদ্দিন ইবনে আরবী (রহ.), মওলানা তোরাব আলী কলন্দর (রহ.), জৈনপুরী হযরত শাহাবুদ্দিন (রহ.), কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মুদাররিছ হযরত মওলানা ছফিউল্লাহ (রহ.), সুপ্রসিদ্ধ মোহাদ্দেস মওলানা আবদুল হক (রহ.) প্রমুখ অলিউল্লাহগণ হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) গাউছে আজমিয়তের স্বীকৃতিপূর্বক তাঁর গুণগান করেছেন। এছাড়া ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা আল কাদেরী (রহ.), বাহারুল উলুম হযরত সৈয়দ আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী (রহ.), মুফতিয়ে আজম আল্লামা সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী (রহ.)সহ যুগশ্রেষ্ঠ আলেমগণ তাঁেদর স্ব স্ব কিতাবে গাউছে আজমিয়তের স্বীকৃতি দিয়ে ব্যাখ্যাসহকারে বিবৃত করেছেন।
গাউছিয়াতের এ মহিমা জারি রাখার মানসে হযরত আকদাছের জীবদ্দশায় হযরত মওলানা শাহ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীকে (ক.) স্থলাভিষিক্ত করে যান। হযরত অছিয়ে গাউছুল আজম সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে মাইজভাণ্ডারী তরিকার খেলাফত ও একমাত্র অধিকার তার হাতে ন্যস্ত হয়। তরিকতের সার্বিক কার্যকলাপ এবং দরবারের শরাফত সুরক্ষা জারি রাখার জন্য অছিয়ে গাউছুল আজম (ক.) তৎপরবর্তী স্থলাভিষিক্ত সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত করে হযরত মওলানা শাহ সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী (ম.জি.আ) ছাহেবকে ১৯৭৪ সালে দায়িত্ব প্রদান করেন।
গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (ক.) ১৩২৩ হিজরী সনে বাংলা ১৩১৩ সালে ইংরেজি ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ১২৬৮ মঘীয় ১০ই মাঘ মোতাবেক ২৭ জিলক্বদ সোমবার দিবাগত এক পবিত্র মুহূর্তে রাত ১টার সময় ৭৯ বছর বয়সে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে তিনি এ ধরাধাম ত্যাগ করেন।
প্রতি বছর গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) ওরস শরিফ ১০ মাঘ মহাসমারোহে বর্তমান সাজ্জাদানশীন কেবলার তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
লেখক : এভিপি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড
রিসার্চ ফেলো, দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউট