সুন্দরবনের উপর দিয়ে আজ অতিক্রম করবে ‘আম্ফান’

আঘাতের সময় ভরা জোয়ার থাকায় জলোচ্ছ্বাস হবে

মোংলা ও পায়রার জন্য ৭ এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের জন্য ৬ নম্বর বিপদ সংকেত

ভূঁইয়া নজরুল :

ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে আজ সন্ধ্যার পর থেকে খুলনা ও বরিশাল উপকূল অতিক্রম করবে। তবে গতি কমালেও উপকূলীয় এলাকায় ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত করতে পারে ‘আম্ফান।  আর যখন এটি আঘাত করবে তখন সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় ভরা জোয়ারের সময়। এতে উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে ১০ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

এই অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে। মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের ২৮ নম্বর বুলেটিনে মোংলা ও পায়রার জন্য ৭ নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের জন্য ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে রেখেছে।

সুন্দরবনের উপর দিয়ে যাবে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান?

ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর, উইন্ডি, আকু ওয়েদার, ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপাত্ত ও মডেল দেখে আবহাওয়াবিদদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড়টি আজ বুধবার সন্ধ্যা সাতটার পর বাংলাদেশের সুন্দরবনের উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। এসময় সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশাল এলাকায় ঘন্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বাতাস প্রবাহিত হবে। সেই সাথে থাকবে ৫ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার বাড়তি জোয়ার।

এবিষয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ঢাকা প্রধান অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিব বলেন,‘ ঘূর্ণিঝড়টি সুন্দরবনের উপর দিয়ে যাবে। আর ঝড়ের সাথে বাড়তি জোয়ারের কারণে উপকূলীয় এলাকায় বেশি ড়্গয়-ড়্গতি হতে পারে।’

তবে ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের ২৯ নম্বর বুলেটিনে বলা হয়েছে, এটি কোলকাতার দীঘা ও বাংলাদেশের হাতিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করবে।

অপরদিকে উইন্ডির মডেল অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়টি গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকে ভারতের ভুবনেশ্বর, বালেশ্বর এলাকায় আঘাত করতে করতে উত্তর-পূর্ব দিকে সরে আসছে। সর্বশেষ কাল দুপুরে কোলকাতার খড়গপুর ও হলদিয়ায় আঘাতের পর তা সুন্দরবনের উপর দিয়ে স্থলভাবে উঠে যাবে। স’লভাবে উঠে কুষ্টিয়া ও যশোরের উপর দিয়ে উত্তরদিকে অগ্রসর হবে। এতে এসব এলাকায় প্রচুর বৃষ্টি হবে।

ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের ট্র্যাক ম্যাপ ও আকু ওয়েদারের ট্র্যাক ম্যাপও  বলছে একই কথা। যে এটি ভারতের উপকূলে আঘাত করতে করতে পূর্ব দিকে সরে এসে সুন্দরবনের উপর দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে। আর সেই হিসেবে তা আজ বুধবার সন্ধ্যার পর উপকূল অতিক্রম করবে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। আজ বিকালে পতেঙ্গা এলাকা থেকে তোলা ছবি- রনী দে

 

জলোচ্ছাস কেমন হবে?

যেকোনো ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছাবস একটি বড় ফ্যাক্টর। সাগর থেকে তীব্র বেগে বাতাস আসার সময় যে প্রচুর পরিমাণ পানি নিয়ে আসে। আর এটিকে জলোচ্ছ্বাস বলে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো আজ সন্ধ্যায় সাতটার দিকে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় জোয়ার নাকি ভাটা। যদি জোয়ার হয় তাহলে ভয়ের কারণ বেশি, আর ভাটা হলে ভয় কিছুটা কম।

এবিষয়ে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মলিস্নক বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি যেসময়ে সুন্দরবন উপকূল অতিক্রম করবে সেসময়ে ( সন্ধ্যা ৭টা) ভরা জোয়ারের সময়। তাই এর প্রভাবে ৫ থেকে ১০ ফুট বাড়তি উচ্চতার জোয়ারের কথা বলছি আমরা। আর এই বাড়তি জোয়ারে উপকূলীয় এলাকা ছাড়াও সাগর ও মোহনায় দ্বীপ ও চরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেসব এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

এই জলোচ্ছ্বাস কি পুরো উপকূলীয় এলাকায় হতে পারে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দূরত্বের হিসেবে জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা কমে আসবে। তবে দ্বীপ ও চরগুলো বেশি ড়্গতিগ্রসত্ম হতে পারে।

বাড়তি জলোচ্ছ্বাসের বিষয়টি ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং আকু ওয়েদারও তাদের পূর্বাভাসে বলেছে।  সেখানেও বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকাগুলো।

সুপার সাইক্লোন তকমা হারিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’

ঘন্টায় ২২০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে টানা তিন মিনিট কোনো ঝড় হলে তাকে সুপার সাইক্লোন বলা হয়ে থাকে। আম্ফানকে প্রথমে সেই মাত্রার ঝড় ( ঘণ্টায় ২৪৫ কিলোমিটার ঘোষণা করেছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর) ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন’ গতকাল দুপুরে এটি দুর্বল হয়ে যায়। আর এই দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে গতি হারিয়ে সুপার সাইক্লোনের তকমা হারিয়েছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। সাধারণত ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটারের অধিক গতিতে কোনো ঝড় হলে আমরা তাকে ঘূর্ণিঝড় বলে থাকি।

ঘূর্ণিঝড় দুর্বল হয়ে যাওয়ার বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর পতেঙ্গা কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কানিত্ম পাল বলেন,‘ ঘূর্ণিঝড় আম্ফান গতকাল দুপুরের আগে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মূল ঝড় থেকে একটি খ- সরে যায়। আর সরে যাওয়ার সাথে সাথে তা দূর্বল হয়ে গতি কমিয়ে ফেলে। এজন্যই তা সুপার সাইক্লোন তকমা হারিয়েছে।’

সেই বিচ্ছিন্ন খন্ডটি কোনদিকে গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটি পূর্ব দিকে ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দিকে চলে যায়। এই বিচ্ছিন্ন খণ্ডের কারণে গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে কিছু বৃষ্টি হয়েছিল।

তাহলে কি দুর্বল হয়ে উপকূলে আঘাত করবে ‘আম্ফান’?

প্রথমদিকে ঘণ্টায় ২৪৫ কিলোমিটার বলা হলেও শেষ পর্যন্ততা ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটারে উপকূলে আঘাত করবে বলে ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের ২৯ নম্বর বুলেটিনে বলেছে। তবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের ২৮ নম্বর বিশেষ বুলেটিনে বলেছে, ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ২০০ কিলোমিটার থেকে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্তবৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে উপকূলীয় এলাকায় আঘাতের সময় এর গতিবেগ ঘন্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার হবে।

এবিষয়ে পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন,‘ ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাসও কিন’ কম শক্তিশালী নয়। এই বেগে ঝড় হলে উপকূলীয় এলাকায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ২৮ নম্বর বুলেটিন অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি গতকাল রাত ৯টায় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ৭৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা থেকে ৬১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা খেকে ৬১০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস’ান করছিল। ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে উত্তর উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড়টি আজ বুধবার সন্ধ্যা নাগাদ সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এজন্য মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ছয় নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রমের সময় উপকূলীয় এলাকায় প্রচন্ড গতিতে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে। এজন্য সাতড়্গীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লড়্গীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং এসব এলাকার পাশ্ববর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে স্বাভাবিকের চাইতে পাঁচ থেকে ১০ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এসময় এসময় এসব এলাকায় ঘন্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে।