বালি খুঁড়ে পাওয়া কয়লায় চলে জীবন

সুপ্রভাত ডেস্ক :
নদীর চরে চলছে খোঁড়াখুড়ি, তৈরি হচ্ছে বড় বড় গর্ত, বেরিয়ে আসছে অমূল্য সম্পদ। নাহ, কোনো গুপ্তধন নয় কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিকদের কোনো গবেষণাও নয়। বেরিয়ে আসছে একদল অভাবী মানুষের জীবিকার রসদ। এমণ চিত্র আপনার চোখে ধরা পরবে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা বালুচরে। গ্রামের শত শত মানুষ তাদের জীবিকার রসদ খুঁজে বেড়াচ্ছে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখিও তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।’ উল্লেখিত কথাটি কবি হয়ত রূপক অর্থেই ব্যবহার করেছিলেন। তবে রূপক কথাটি বাস্তব হয়েছে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রম ইউপির হাজারো পরিবারের। তবে এবার ছাই থেকে নয় বালির মধ্যে রসদ খুঁজে চলেছে একদল অভাবী মানুষ।
ধু-ধু বালুচর কিংবা পানিতে টইটুম্বুর। বর্ষা আর শুষ্ক মৌসুমে যাদুকাটা নদীর চিরাচরিত দুই রূপ। মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁসে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলের যাদুকাটা নদী মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস। এখানকার চরগুলো শুধু বালুচরই নয়, চরের ভাজে ভাজে রয়েছে নানা সম্পদ। চরে তাই অভাবী মানুষের ভিড়।
প্রতিদিন তারা দলবেঁধে চরে আসে। সঙ্গে থাকে ঝুড়ি আর লোহার সিক। কারো সঙ্গে আবার দুপুরের খাবার। তবে বেশিরভাগ মানুষেরই দুপুরের খাবারের যোগান থাকে না। বালি খুঁড়ে বের করে পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসা গাছের জীবাশ্ম। কয়লায় রূপান্তরিত হওয়া এই জীবাশ্ম তারা বিক্রি করে রোজগার করে। এগুলো জ্বালানি হিসেবেই মূলত বিক্রি হয়।
ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে যাদুকাটা নদীটি তাহিরপুর উপজেলার উত্তর পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটি বাংলাদেশ সীমান্তের প্রায় ৫ কিলোমিটার ভেতরে উপজেলার ফাজিলপুরে নামক স্থানে নাম নিয়েছে রক্তি। এখানেই নদীটি বৌলাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। বৈচিত্রময় মনোহর রুপের কারণে পাহাড়ী নদী যাদুকাটাকে দেশের অন্যতম সৌন্দর্য্যরে নদী হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
শুধু সীমান্ত নদী যাদুকাটাই নয়! পাশাপাশি সীমান্তের ১৮টি ছড়া থেকেও কয়লা কুড়িয়ে জীবনযাপন করছেন ওইসব শ্রমিকরা। এ কাজের মাধ্যমে প্রায় অর্ধসহগ্রাধিক নারী শ্রমিক হয়ে উঠেছেন আত্ম-নির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী। মায়ের সঙ্গে ছোট ছোট বাচ্চারাও চলে আসে বালুচরে। তাদের এক ঢিলে দুই পাখি। একদিকে খেলাও হয়, অন্যদিকে কয়লারও জোগাড় হয় কিছু। সেগুলো মায়ের কাছে দিয়ে সংসারের খরচে কিছুটা শামিল হওয়া।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলাটি অবস্থিত। সুনামগঞ্জ জেলার ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সু-উচ্চ মেঘালয় পাহাড় ঘেষা সীমান্ত লাগোয়া একটি জনপদের নাম তাহিরপুর। এ জনপদের বেশির ভাগ জনসাধারণ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত।
প্রতিবছর বর্ষায় ভারত থেকে প্রবাহিত গ্রোতধারায় যাদুকাটা ও সীমান্ত ছড়াগুলো দিয়ে বালুর সাথে মিশে থাকা কয়লা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে কয়লা তোলার পর প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পানির গ্রোতের সাথে নুড়ি, বালুমিশ্রিত কয়লা যাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ ও সীমান্ত ছড়াগুলোর পানিতে দেখা যায়।
সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রধান জীবিকা হলো যাদুকাটা নদীতে ভারত থেকে প্রাকৃতিকভাবে পানির গ্রোতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নেমে আসা বালুর সাথে মিশে থাকা কয়লা কুড়ানো। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুখর যাদুকাটা নদীর উৎসমুখ থেকে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত এ নদীতে প্রতিদিন এ কাজ করে থাকে লক্ষাধিক শ্রমিক।
কয়লা শ্রমিকদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী। তারা বালুমিশ্রিত কয়লা প্রথমে ঠেলা জালিতে তুলে ও পানিতে ছেঁকে বালু থেকে আলাদা করে বস্তায় ভরে রাখে। পরে প্রতি বস্তা কয়লা সাড়ে তিনশ থেকে চারশ টাকা দরে স্থানীয় কয়লা মহাজনদের কাছে বিক্রি করে। তবে গাছের জীবাশ্ম মহাজনেরা কেনেন মণ হিসেবে। কেউবা এগুলো থেকে কয়লা বানান কেউবা সরাসরি এভাবেই বিক্রি করেন।
জনজীবনের বিচিত্রসব দিক লাওরের গড় বালুচরকে করেছে নানা রঙে বর্নাঢ্য। দিনের বেলা এখানে হাজার হাজার মানুষ কাজ করে বালি, পাথর আর কয়লা উঠানোর কজ। আর রাতের চিত্র একরাশ সুনসান নিরবতা। খবর : ডেইলিবাংলাদেশ’র।