নালায় পড়ে মারা যাওয়ার নেপথ্যে

সেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া

ভূঁইয়া নজরুল »
প্রায় ১০ ফুট চওড়া ও ১০ ফুট উচ্চতার নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন মেয়ে মরবে কেন? ঢালু থাকার কারণে পানির গভীরতা হাঁটু সমানের কম, সেই নালায় পড়ে মানুষ মারা যায়? আবার নালায় পড়ে যাওয়ার পর তাকে উদ্ধারের জন্য সাথে থাকা মামা নামলেও তিনি উদ্ধার করতে পারেনি, মেয়েটি উধাও হয়ে গেল। আবার একই স্থানে সম্প্রতি আরো ছয় জন পড়লেও কারো মৃত্যু হয়নি। তাহলে নালায় পড়ে যাওয়া সেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯) মারা গেল কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রথমে নালার বৈশিষ্ট্য জানা প্রয়োজন, নালার কোন পয়েন্টে পড়েছিল সাদিয়া, লাশটি কোথায় পাওয়া গেছে একইসাথে উদ্ধার করা ডুবুরিরা কি বলছে এসব উত্তর বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আগ্রাবাদ মগ পুকুর পাড় এলাকা থেকে আসা নালাটি প্রায় ১০ ফুট চওড়া। ফুটপাত থেকে এই নালার গভীরতা প্রায় ১০ ফুট।
১০ ফুট ওপর থেকে পড়ে নিখোঁজ হলো কেন?
সিটি করপোরেশন এই নালাটি নির্মাণ করলেও এই নালার তলদেশের চিত্র কেমন এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একাধিক প্রকৌশলীর সাথে কথা বলেও জানা যায়নি। তাহলে কে জানাবে এর চিত্র? ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে দুর্ঘটনার পর উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।
এবিষয়ে ফায়ার সার্ভিস আগ্রাবাদ স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘সেদিন আমিও নেমেছিলাম নালায়। তবে নালাটি বিপদজ্জনক। নালায় নামার পর আমি নিজেই নিচের দিকে চলে যাচ্ছিলাম।’
কেন বিপদজ্জনক এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে তিনি বলেন, নালাটির তলা পাকা ছিল। তলা পাকা থাকার কারণে দীর্ঘদিনের জমে থাকা পানিতে তলায় শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। আবার নালাটির ফ্লোর সমান নয়। ফ্লোরটি ঢালু হয়ে প্রায় ১০ ফুট নিচে আগ্রাবাদ বক্স কালভার্টের সাথে যুক্ত হওয়াতে প্রায় খাড়া ঢালু।
তিনি আরো বলেন, মেয়েটি যে স্থানে পড়েছিল সেই স্থানে নালায় হাঁটুর নিচে পানি ছিল। উপর থেকে নিশ্চই বাম পা পিছলে মেয়েটি পড়েছিল। পড়ার সাথে সাথে বাম দিকে কাত হয়ে নালায় পড়ে। এতে মাথায় আঘাত পেয়ে থাকতে পারে। আর ফ্লোরটি পিচ্ছিল ও খাড়া ঢালু হওয়ায় পড়ার সাথে সাথে নিচের দিকে চলে যায় পানির স্রোতে। কিন্তু নিচের দিকে গিয়ে মাথা উপরে তোলার সুযোগ নেই। কারণ উপরে রাস্তার স্ল্যাব। আর তা গিয়ে যুক্ত হয়েছে শেখ মুজিব রোডের রাস্তার নিচ দিয়ে যাওয়া আগ্রাবাদ বক্স কালভার্টের সাথে। এই বক্স কালভার্ট দিয়ে দেওয়ানহাট, চৌমুহনী, আগ্রাবাদ, গোসাইলডাঙ্গা এলাকার পানি কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ে।
লাশটি কোথায় পাওয়া গেল?
লাশ উদ্ধার করেছে জাহিদ হাসান ও প্রদীপ বিশ্বাস নামের দুই ডুবুরি। গত রোববার ফায়ার সার্ভিসে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় ওই ডুবুরিদের সাথে। দুই ডুবুরির একজন (জাহিদ হাসান) বক্স কালভার্ট থেকে লাশ উদ্ধার করেছে এবং অপর ডুবুরি রশির মাধ্যমে অপরজনকে সংকেত দিয়েছে।
জাহিদ হাসান বলেন, আমার সহযোগী ডুবুরি প্রদীপ বিশ্বাস বলেছিল বক্স কালভার্টের দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। যেহেতু নালাটি ঢালু ছিল তাই নামার সাথে সাথে স্লিপ কেটে নিচের দিকে চলে যাই। বক্স কালভার্টটি সমান ছিল। ওখানে পানি না থাকলে যে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কিন্তু পানি থাকলে ভেসে থাকতে পারবে না।
তাহলে লাশ কোথায় পেলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নালাটি বক্স কালভার্টের যে স্থানে যুক্ত হয়েছে সেখান থেকে প্রায় ২০ ফুট দূরে (আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ের দিকে) কালভার্টের দেয়ালের সাথে লাগোয়া অবস্থায় ছিল।
বক্স কালভার্টের চওড়া ও গভীরতা কত?
আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডের বক্স কালভার্টটি রাস্তার ডান পাশে ( মাজার গেইট থেকে বাদামতলী যাওয়ার পথে)। তাহলে মগ পুকুর পাড় থেকে আসা নালাটি রাস্তার একপাশ ( প্রায় ৩৮ ফুট দূরত্ব) অতিক্রম করে রোড ডিভাইডার পার হয়ে বক্স কালভার্টের সাথে যুক্ত হয়েছে। এই রোডের উপর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। আর তা বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স রেনকিন জেবি। সিডিএ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বক্স কালভার্টের গভীরতা ১০ ফুট ও চওড়া ১০ ফুট।
নালার ডিজাইনগত ত্রুটি কি ছিল?
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, নালাটি এমনভাবে ঢালু অবস্থায় রয়েছে এখানে যে পড়বে সে নিচে চলে যাবে। কিন্তু এর আগে এখানে আরো ছয় জন পরলেও কিংবা সাদিয়াকে উদ্ধারের জন্য মামা জাকির হোসেন লাফ দিলেও তিনি হারিয়ে যাননি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের এনামুল হক বলেন, ‘বাকিরা হয়তো যে স্থানে ময়লা বেশি ছিল সেই স্থানে পড়েছে। সেখানে ময়লার স্তূপ ছিল। যে কেউ ময়লার উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। আর মামা তো প্রস্তুতি নিয়ে লাফ দিয়েছে ময়লার উপরে।
এ বিষয়ে মামা জাকির হোসেনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও পাওয়া যায়নি। তবে সাথে থাকা নানা মোহাম্মদ জামাল বলেন, ‘সাদিয়া আমার সামনে ছিল। হাঁটার সময় সে পড়ে যায় হঠাৎ করে। আর পরে যাওয়ার সাথে আমার ছেলে ( জাকির হোসেন) মোবাইল লাইট জ্বালিয়ে দেখে নিচে কেউ নেই। পড়ে সে নিচে নেমেও খুঁজে পায়নি।’
নালার ডিজাইনগত কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘নালাটি বক্স কালভার্ট থেকে উঁচুতে হবে এবং ঢালু হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ অন্যথায় পানি নিচের দিকে যাবে না। তবে যে কেউ নালায় পড়ে যাতে আবদ্ধ ড্রেনে যেতে না পারে সেজন্য নালাটিকে সুরক্ষিত রাখা যেতে পারতো। অন্যথায় সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মী থেকে শুরু করে যে কেউ নালা দিয়ে আবদ্ধ ড্রেনে চলে যেতে পারে।’
উল্লেখ্য, গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। এসময় ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সাদিয়া নালায় পড়ে যায়। পরবর্তীতে পাঁচ ঘণ্টা উদ্ধার অভিযানের পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তার লাশ উদ্ধার করে। এর আগে চশমা খালে সিএনজি পড়ে গিয়ে দুই যাত্রী নিহত হয়েছিল, মুরাদপুরে খালে পড়ে নিখোঁজ হয়েছিল সালেহ আহমেদ। কিন্তু নালায় পড়ে এভাবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি।