তিন পেশার তিন করোনা যোদ্ধা

করোনার নমুনা পরীক্ষা, রোগীদের চিকিৎসা ও সেবা নিয়ে কাজ চলছে ল্যাবরেটরিতে ও হাসপাতালগুলোতে। যারা এই সেবা দিচ্ছেন তারা কিভাবে এসব কাজ করছেন এবং করোনা  থেকে কিভাবে নিজেদের মুক্ত রাখছেন তা নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট বিআইটিআইডির করোনা পরীক্ষার ল্যাব প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ, করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রামের বিশেষায়িত হাসপাতাল আন্দরকিল্লায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব ও একই হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স হাজেরা বেগমের সাথে। তাদের সাথে কথোপকথন তুলে ধরছেন সুপ্রভাতের প্রধান প্রতিবেদক ভূঁইয়া নজরুল
করোনা পরীক্ষায় সতর্কতার বিকল্প নেই

ডা. শাকিল আহমেদ

মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব প্রধান, ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি

বিআইটিআইডিতে করোনা পরীক্ষা শুরু হয় ২৫ মার্চ থেকে।  চীনের উহানে করোনা দেখা দেয়ার পর আইইডিসিআর দেশে জানুয়ারি মাসেই কাজ শুরু করে করোনা নিয়ে। আর তখন থেকেই করোনার সাথে যুক্ত ডা. শাকিল আহমেদ।

অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই জীবাণু নিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করছেন, প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ নমুনার পরীক্ষা করছেন, জীবাণুর সাথে বসবাস করলেও তিনি জীবাণু তাকে সংক্রমণ করতে পারেনি। কিভাবে তা সম্ভব হচ্ছে জানতে চাইলে গত ৩২ বছর ধরে চিকিৎসা ও ল্যাবরেটরির কাজের সাথে জড়িত এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘একমাত্র পন্থা হলো সতর্কতা। আমি এবং আমার টিমের সদস্যরা সতর্কতার সহিত কাজ করছি। করোনার নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে রোগীদের সাথে সরাসরি কন্ট্রাক্টে আসতে হয়, নমুনাগুলো ল্যাবরেটরিতে প্রতিনিয়ত ব্যবহার হচ্ছে। তারপরও এখন পর্যন্ত আমাদের টিমের কোনো সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়নি।’

তা কিভাবে সম্ভব হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ সবার আগে বলে দেয়া হয় সতর্কতার সাথে কাজ করতে। কারণ আগে নিজেকে সুস্থ থাকতে হবে। সতর্কতা মেনে এপর্যন্ত সাত হাজারের বেশি নমুনার জীবাণু নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও জীবাণু আমাদের সংক্রমণ করতে পারেনি।’

আপনি সকাল ৮টা ৩০ এ ল্যাবরেটরিতে আসেন রাত সাড়ে ১১টায় বাসায় যান। এতে বাসার লোকজন তথা আপনার পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে থাকেন না? আপনার মাধ্যমে তাদের শরীরেও করোনা সংক্রমিত হতে পারে। এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘ এটা নিয়ে পরিবারের লোকজনের মধ্যে কোনো আতঙ্ক নেই। কারণ আমি সম্পূর্ণ সতর্কতার সাথে কাজ করি এটা তারা জানে। প্রতিদিন রাতে খাবারের টেবিলে ওরা আমার জন্য বসে থাকে। একসাথে আমরা খাবার খাই। তবে তারা আমাকে পূর্ণ সাপোর্ট দিচ্ছে বলে মানসিক প্রশানিত্ম নিয়ে আমি কাজ করতে পারছি। আতঙ্ক থাকলেও তাদের তারা আমাকে পূর্ণ সাপোর্ট দিচ্ছে।

আগামীতে অনেক ল্যাবে করোনা নমুনা পরীক্ষ হবে। সেসব ল্যাবে এবং নমুনা সংগ্রহে যারা কাজ করবে তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি? তিনি বলেন, অবশ্যই বায়োসেইফটি ও বায়োসিকিউরিটি মেনে চলতে হবে। সতর্কতার সহিত কাজ করতে হবে। সতর্কতার বিকল্প নেই।

পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে

ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব

সিনিয়র কনসালটেন্ট, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল

চট্টগ্রামে গত ৩ এপ্রিল করোনা রোগী শনাক্তের পর থেকেই চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়েছে। সেই থেকে এপর্যন্ত প্রায় ৫০০ করোনা রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়েছে জেনারেল হাসপাতাল। করোনার লক্ষণ ও করোনা রোগী উভয় ধরনের রোগীদের সাথে দিনাতিপাত করলেও নিজে এখনো করোনা সংক্রমিত হননি। তবে সেই আশঙ্কায় নিজের পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র পাঠিয়ে বাসায় একা থাকছেন এই হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব। সন্দ্বীপে জন্ম নেয়া ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব গত ১৮ বছর ধরে চিকিৎসাসেবায় রয়েছেন।

করোনার সাথে বসবাস করে কিভাবে পারিবারিক জীবন সামলাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘করোনার ভয়ে পরিবারের স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হালিশহরে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি একা পাঁচলাইশের বাসায় থাকি। আমার কাছ থেকে যাতে তারা আক্রান্ত না হয় সেই জন্য এই কাজ করা হয়েছে।‘

তাহলে আপনার খাবার কিভাবে হচ্ছে? তিনি বলেন, ওই বাসা থেকে রান্না করে পাঠিয়ে দেয়। ফ্রিজে রেখে তা গরম করে খাই। এটা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

কিন’ প্রতিদিন রোগীদের সাথে থাকতে হচ্ছে। এতে করোনা আক্রান্তের হাত থেকে কিভাবে রক্ষ পাচ্ছেন এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, রোগীদের কাছে যাওয়ার সময় পরিপূর্ণ প্রটেকটিভ অবস্থায় যাচ্ছি। একইসাথে রোগীদের সাথে যতটা সম্ভব সরাসরি কন্ট্রাক্টে কম থাকা যায় সেই চেষ্টা করে তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি। কারণ আমাদের সুস্থ থাকতে হবে, আমরা সুস্থ থাকলে রোগীদের সেবা দিতে পারবো।

চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কি? এর জবাবে ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, ‘প্রতিবার রোগীর সাথে কথা বলার পর এসে হাত ধুয়ে নিতে হবে। একইসাথে ডাক্তারদের সুরক্ষা পোশাকগুলোর পাশাপাশি মাস্ক, গ্লাভস, গগলস ও ফেইস সিল নামে একটি পস্নাস্টিকের আবরণ রয়েছে সেটি ব্যবহার করতে হবে।‘

সন্তানরা থাকে দাদী, নানী, ফুফু,
চাচী খালাদের কাছে

হাজেরা বেগম

সিনিয়র স্টাফ নার্স, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল

ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশন লিখে দেন। সেই সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রোগীদের স্যালাইন দেয়া, ওষুধ খাওয়ানো, পালস মাপা, অক্সিজেন দেয়াসহ অনেক ধরনের সেবা দিতে হয় রোগীদের। আর এই কাজটি সরাসরি করছে নার্সরা। এবিষয়ে জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স হাজেরা বেগম বলেন, আমাদের এখন আর পারিবারিক জীবন নেই। টানা দুই মাস কাজ করেছি। বাসায় যেতে পারেনি। এখন জনবল বাড়ায় কিছুটা হয়তো গ্যাপ (ছুটি) পাচ্ছি, কিন’ সেই গ্যাপ সময়ে থাকতে হচ্ছে হাসপাতাল নির্ধারিত কোয়ারেন্টিনে। কখনো আঞ্চলিক লোক প্রশাসন কেন্দ্র কখনো বা হাসপাতাল নির্ধারিত কোনো হোটেল বা মোটেল।

তাহলে কি বাসায় যেতে পারছেন না? তিনি বলেন, আমার পরিবারের চার সদস্য এখন তিন স্থানে রয়েছে। আমি আছি করোনা চিকিৎসার কাজে। বাসায় যেতে পারছি না। দুই সন্তানকে পাঠিয়ে দিয়েছি ওদের নানীর বাসায়। আমার স্বামী স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করছেন রাঙ্গামাটির লংগদুতে। শুধু আমি না, আমাদের অনেকের সন্তানকে এখন দাদী, নানী, ফুফু, খালা ও চাচীদের কাছে।

তিনি বলেন, করোনা চিকিৎসায় সব ছেড়ে এখন শুধু মানুষের সেবা করাই আমাদের কাজ। তবে এই কাজ করতে গিয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা উপকরণ ব্যবহার করেই আমরা কাজ করছি। তারপরও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে।