তালেবান অধ্যায় শুরু

সরকার গঠনে দোহায় বৈঠক, দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরে আফগানদের জনস্রোত, কাবুল বিমানবন্দরে পাঁচজন নিহত

সোমবার কাবুল বিমানবন্দরে হুড়োহুড়ি করে বিমানে ওঠার চেষ্টা।

সুপ্রভাত ডেস্ক »
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের পর কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানের ভবিষ্যৎ সরকারের কাঠামো ও নাম নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনা শেষে শিগগিরই এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে তালেবান।
তালেবানের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা আফগান সংবাদমাধ্যম তোলো নিউজকে বলেছেন, তাদের নেতৃত্ব দোহায় আলোচনায় ব্যস্ত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আফগানিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তালেবান যোগাযোগ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তালেবানের রাজনৈতিক শাখার উপ-প্রধান মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার বলেছেন, ‘এখন এই মুহূর্তটি তালেবানের জন্য একটা পরীক্ষা। এই সময়ে আমরা একটি পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছি। কারণ এখন দেশের জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের কাঁধে।’
কাবুলের বাসিন্দা আহমদ ফরিদ বলেন, ‘এমন এক সরকার হওয়া উচিত যেখানে সবার অংশগ্রহণ থাকবে। সেখানে স্থিতিশীলতা থাকতে হবে। কাবুলের আরেক বাসিন্দা ফজল রাবি তোলো নিউজকে বলেন, ‘দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ মানুষ যুদ্ধে ক্লান্ত।’
আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকার ও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পরিচিত হিজব-ই-ইসলামির নেতা গুলবুদ্দীন হেকমাতিয়ার বলছেন, আশরাফ গনির ব্যর্থতা দেশকে আজ এমন একটি পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিতে গঠিত একটি স্বঘোষিত পরিষদের সদস্য হেকমাতিয়া রোববার সন্ধ্যায় আগে রেকর্ড করা একটি বার্তায় বলেন, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের মধ্যে সহিংসতা বন্ধ ও আফগানিস্তানের সংকট শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করার কোনও প্রস্তুতি দেখা যায়নি।’
আফগানিস্তানের ন্যাশনাল সলিডারিটি পার্টির প্রধান আফগান রাজনীতিবিদ সৈয়দ ইসহাক গাইলানি বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের এমন একটি সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করা উচিত; যারা গত দুই দশকের অর্জনগুলো সংরক্ষণ করবে।’
রোববার তালেবান কাবুল দখলের পর দেশত্যাগকারী প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি সম্পর্কে সৈয়দ গাইলানি বলেন, ‘আশরাফ গনি রাষ্ট্রদ্রোহ করেছেন এবং তিনি দেশত্যাগ করেছেন। এখন তাদের (তালেবান) দ্রুত সরকার গঠন করা উচিত। অন্যথায়, মানুষ উদ্বেগের মধ্যে থাকবে।’
কাবুল দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট শূন্য
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পরদিন শহরের রাস্তাঘাট হয়ে পড়ে জনশূন্য। শহরের বড় অনেক দোকানের পাশাপাশি ছোট ক্যাফেগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর নিরাপত্তা রক্ষীদের খোঁজ মেলেনি।
সোমবার সকালে শহরে এমন চিত্র দেখা গেলেও বিপরীত চিত্র দেখা গেছে কাবুল বিমানবন্দরে। সেখানে বিরাজ করছে পুরো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
তালেবান শাসন ফিরে আসার আতঙ্কে প্রাণ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালানোর হিড়িক পড়ে গেছে আফগানদের মধ্যে। কাবুলের বিমানবন্দরে ছুটে যাচ্ছে মানুষ। একে অপরকে ঠেলে যে ভাবেই হোক বিমানে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে।
কাবুল বিমানবন্দর জনসমুদ্রে পরিণত হওয়ার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাতেই দেখা গেছে, বিমানে কে আগে উঠবেন তা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি। অনেককে আবার সিড়ির রেলিংয়ে ঝুলেই বিমানের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। তবে এসব ভিডিও যাচাই করতে পারেনি রয়টার্স।
সেখানে অন্তত পাঁচ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে তারা গুলিতে না ভিড়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন তা তাৎক্ষণিকভাবে পরিষ্কার হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী দেশগুলোর কূটনীতিক এবং কর্মীদের সরিয়ে নিতে কাবুল বিমানবন্দরের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে মার্কিন সেনারা। তারা এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
যারা রাজধানী থেকে পালাতে চাইছেন তাদের দূরে সরিয়ে রাখতে বিমানবন্দরের রানওয়েতে কাঁটাতারের বেড়াও দিচ্ছে সেনারা।
কাবুল তালেবানের দখলে চলে যাওয়া দ্বিতীয় দিনে পড়েছে। প্রথমদিন থেকে রাজধানী কাবুলের পরিস্থিতি কেমন তা কয়েকটি ছবি দিয়ে তুলে ধরেছে বিবিসি। তাতে দেখা গেছে, কাবুলের রাস্তায় রাস্তায় তালেবান।
কাবুলের বিমানবন্দর মানুষে ঠাসা হলেও শহরের পথঘাট সব ফাঁকা। কাবুলে প্রথম সকালটা যে আফগানদের জন্য স্বস্তির ছিল না আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবরে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যেমের খবরে বলা হয়েছে,তালেবান নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে কাবুলে। দোকান-পাট সব বন্ধ হয়ে কাবুল ভূতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে। দোকান মালিকরা এরপর গ্রাহক পাবেন কোথায় তা নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে একজন দোকান মালিক বলেছেন, ‘শহরে তালেবান ঢুকেছে। আমি ভয়ে আছি। কিন্তু আমাদের সবাইকে প্রেসিডেন্ট গানির ছেড়ে চলে যাওয়া পরিস্থিতিকে আরও চরম খারাপ করে তুলেছে।’
কাবুলের সরকারি দপ্তরগুলো ফাঁকা পড়ে আছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। প্রায় সব কূটনীতিক তাদের পরিবার নিয়ে শহরটি ছড়ে চলে যাওয়ায় নগরীর ওয়াজির আকবর খান কূটনৈতিক এলাকা জনশূন্য হয়ে আছে।
এমনিতে অত্যন্ত সুরক্ষিত এই এলাকাটির চেকপয়েন্টগুলোতে এখন অল্প কয়েকজন রক্ষী আছেন। কিছু গাড়িচালক নিজেরাই গাড়ি থেকে বের হয়ে চেকপয়েন্টের বাধা সরিয়ে গন্তব্যের পথে রওনা হন।
এই এলাকায় নিজের নান রুটির দোকানে বসা গুল মোহাম্মদ হাকিম বলেন,‘এখানে বসে ফাঁকা রাস্তা দেখতে অদ্ভুত লাগছে, দূতাবাসের ব্যস্ত গাড়িবহর, মেশিনগান বসানো বড় বড় গাড়ি আর নেই।
‘রুটি বানাতেই এখানে এসেছি, কিন্তু আয় তেমন একটা হবে না। যে নিরাপত্তা রক্ষীরা আমার বন্ধু ছিল তারা চলে গেছে।’ সে সময় পর্যন্ত কোনো ক্রেতার দেখা পাননি তিনি, কিন্তু তাদের অপেক্ষায় চুলা জ্বালিয়ে রেখেছেন।
‘আমার প্রথম কাজ হচ্ছে দাঁড়ি রাখা, কীভাবে এগুলোকে দ্রুত বাড়ানো যায় তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আছি। স্ত্রী ও মেয়েদের জন্য যথেষ্ট বোরকা আছে কিনা তাও দেখে রেখেছি আমরা,’ বলেন হাকিম।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবান আমলে পুরুষদের দাঁড়ি কাটার অনুমতি দেওয়া হতো না এবং নারীদের জনসম্মুখে আপাদমস্তক বোরকা ঢাকা অবস্থায় চলাফেরা করতে হতো।
নগরীর চিকেন স্ট্রিটের সব দোকান বন্ধ ছিল। এখানে আফগানিস্তানে তৈরি কার্পেট, হস্তশিল্প ও অলঙ্কারের দোকানের পাশাপাশি ছোট ছোট ক্যাফে আছে।
এখানে একটি কার্পেট ও কাপড়ের দোকানের মালিক শেরজাদ করিম স্টানেকজাই জানান, মালপত্র রক্ষার জন্য দোকানের শাটার ফেলে ভেতরে ঘুমিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
‘আমি পুরোপুরি মর্মাহত অবস্থায় আছি। তালেবান শহরে প্রবেশ করায় আমি শঙ্কিত, কিন্তু আমাদের সবাইকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে (প্রেসিডেন্ট আশরাফ) গনির চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে খারাপ হয়েছে,’ বলেন তিনি।
‘এই যুদ্ধে সাত বছরে তিন ভাইকে হারিয়েছি আমি, এখন আমাকে আমার ব্যবসা রক্ষা করতে হবে।’ তার পরবর্তী ক্রেতা কোথা থেকে আসবেন সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই বলে জানান তিনি।
‘এখানে বিদেশি কেউ আর নেই, কোনো বিদেশি এখন আর কাবুলে আসবেনও না,’ বলেন তিনি। এক তালেবান নেতা জানিয়েছেন, আফগানদের দৈনন্দিন কার্যক্রম শুরু করতে দিতে ও বেসামরিকদের আতঙ্কিত না করতে তাদের যোদ্ধাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । খবর বিডি ও ঢাকাপোস্ট।
‘আরও অনেক ভালোভাবে স্বাভাবিক জীবন শুরু হবে, আপাতত এটুকুই বলতে পারি,’ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে রয়টার্সকে বলেছেন তিনি।
হেলিকপ্টারভর্তি অর্থ নিয়ে পালিয়েছেন গনি
কাবুলে তালেবান বাহিনী প্রবেশের মুখে দেশত্যাগ করা আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পালানোর সময় হেলিকপ্টার ভর্তি করে নগদ অর্থ সাথে নিয়ে গেছেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তাসংস্থা আরআইএ নিউজ এজেন্সির বরাত দিয়ে করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স।
বিদায়ের পূর্বে যদিও আশরাফ গনি বলেছিলেন, আফগানিস্তানের জনগণকে রক্তপাত থেকে বাঁচাতেই দেশত্যাগ করছেন তিনি, তবে দেশটির রুশ দূতাবাসের মুখপাত্র নিকিতা ইশেঙ্কো আরআইএকে জানিয়েছেন, তার চলে যাওয়ার ধরনকে একমাত্র পালানোর সঙ্গেই তুলনা করা চলে।
ইশেঙ্কো বলেন, ‘তিনি (আশরাফ গনি) যেভাবে গিয়েছেন, তাকে একমাত্রা পালানোর সঙ্গেই তুলনা করা চলে। প্রেসিডেন্ট প্যালেস থেকে বিদায় নেওয়ার সময় চার গাড়িভর্তি নগদ অর্থ নিয়ে গেছেন তিনি।’
‘বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর অর্থভর্তি সেই ব্যাগগুলো একটি হেলিকপ্টারে বোঝাই করা হয়েছিল। কিন্তু হেলিকপ্টারে সবগুলোর স্থান সংকুলান না হওয়ায় কয়েকটি ব্যাগ রানওয়েতে ফেলে গিয়েছেন তিনি।’
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ দূত জামির কাবুলভ এ বিষয়ে মস্কোভিত্তিক বেতারমাধ্যম ইকো মস্কভিকে বলেন, ‘তিনি কী পরিমাণ অর্থ নিয়ে গেছেন সে সম্পর্কে এখনো কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।’
‘তবে আমি আশা করছি, রাষ্ট্রীয় বাজেটের সব অর্থ নিয়ে তিনি পালাননি। কিছু অর্থ যদি বেঁচে যায়, তাহলে সেটি হবে বর্তমান বাজেটের ভিত্তি।’ রোববার সন্ধ্যায় সরকারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ তাজিকিস্তানের উদ্দেশে কাবুল ছাড়েন গনি। তিনি দেশটির রাজধানী দুশানবেতে পৌঁছালেও তাকে সে দেশে বসবাসের অনুমতি দেয়নি তাজিক সরকার।তারপর সেই রাতেই দুশানবে থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের রাজধানী আম্মানে পৌঁছান তিনি। এখন পর্যন্ত সেখানেই আছেন তিনি ও তার সঙ্গীরা। তবে ওমান সরকার তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আশ্রয় দিয়েছে কি না তা এখনো পরিষ্কার নয়।