টে

মোহীত উল আলম »

অনেকদিন আগের কথা। আমার নাতনি সুরেলা তখন দেশে। এক বছরের সামান্য বেশি বয়স। আধো আধো বুলি ফুটেছে। তার বাবা-মা তার জন্য এক জোড়া নতুন জুতো কিনে এনেছে। সে জুতোজোড়া পরে সুরেলা আমার পড়ার কামরায় ঢুকে আমাকে তার নতুন জুতোজোড়ার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ‘টে’।
‘টে’ বাচ্চামণির ভাষায় জুতো। আর তার হাতের সংকেত দিয়ে সুরেলা তার নতুন জুতোকেই বোঝাল। সুরেলার এ ‘টে’ শব্দটি মনে পড়ল জোনাথন হার্টের ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘কলম্বাস, শেক্সপিয়ার এ্যান্ড দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অব দ্য নিউ ওয়ার্লড’ পড়তে গিয়ে। লেখক এক জায়গায় বলছেন, ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর কলম্বাস প্রথমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে দ্বীপটিতে অবতরণ করলেন সেটির স্থানীয় নাম ছিল গুয়ানাহানি। কলম্বাস তার নতুন নামকরণ করলেন স্যান স্যালভাদর। তিনি একটি চিঠিতে বলছেন যে লুকায়ান গোত্রের এ লোকগুলো ছিল অত্যন্ত নিরীহ, কিন্তু তারপরও তিনি তাদের কয়েকজনকে বন্দী করলেন দোভাষী হিসেবে কাজ করার জন্য।
এখানে সুরেলার সঙ্গে কলম্বাসের যোগসূত্র। সুরেলা তার জুতোকে বোঝাতে ‘টে’ শব্দটি ব্যবহার করেছে আর শারীরিক সংকেতের সাহায্যে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, সে কি বোঝাতে চায়। ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম, কিন্তু ভাষা আসলে মৌখিক সংকেত এবং শারীরিক সংকেত সহযোগে প্রায়শই যোগাযোগ রক্ষা করে। ক্লাসে আমরা যখন বক্তৃতা দিই তখন হাতের আর দেহের নানানরকম অঙ্গভঙ্গি মুখের সাথে সাথে চলতে থাকে।
বইটি পড়তে পড়তে আমার কয়েকটি পুরোনো চিন্তা আবার দানা বেঁধে উঠল। কলম্বাস পর্তুগীজ ভাষা এবং স্প্যানিশ ভাষা জানতেন, আর নতুন বিশ্বের আদিবাসীদের (নেইটিভদের) ভাষা ছিল ভিন্ন । কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থানের মূল নায়ক ক্রিস্টোফরো কলম্বো (ক্রিস্টোফার কলম্বাস) কীভাবে এই যোগাযোগটি স্থাপন করলেন! কে কার ভাষা শিখেছিল প্রথমে? কলম্বাস কি স্থানীয়দের স্প্যানিশ ভাষা শিখিয়েছিলেন, নাকি স্থানীয়রা তাদের ভাষা তাঁকে শিখিয়েছিল? ইতিহাস ঘেঁটে এইসব অতীতকালীন তাৎক্ষণিকতার প্রামাণিক উপাদান পাওয়া অসম্ভব। কারণ ইতিহাস বরাবরই তথ্য এবং কল্পনার মিশেল। কলম্বাস কি এই আদি গোত্রের রাজাকে তার জুতো দেখিয়ে সুরেলার মতো ‘টে’ বলেছিলেন, নাকি সে আদিম গোত্রের রাজা কলম্বাসকে তার জুতোবিহীন পায়ের দিকে ইঙ্গিত করে ‘নো টে’ জাতীয় কিছু বলেছিল। তবে সারাংশ হলো, কলম্বাস বহু স্থানীয় লোককে ক্যাথলিক ক্রিশ্চান বানিয়েছিলেন, এবং অবাধ্যদের নিশ্চিহ্ন করেছিলেন, তাদের স্বর্ণ আর জমি লুট করেছিলেন, আর তাদেরকে ইউরোপিয় ভাষা শিখিয়েছিলেন।
কলম্বাস থেকে ক্লাইভে আসলেও আমার একই কথা মনে হয়। ক্লাইভের আগে পর্তুগীজেরা ভারতবর্ষে পা ফেলে। সম্রাট আকবরের সময় পর্তুগীজেরা সুরাটসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় একবার তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে একজন পর্তুগীজ চিকিৎসক তাঁর রোগ সারান। তাঁর নাম গার্সিয়া ডি অরটা। তিনি প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। আমার প্রশ্ন হলো, তাঁরা যোগাযোগটা কীভাবে স্থাপন করেছিলেন। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ইউরোপিয়রা সমুদ্র অভিযাত্রার প্রাক্কালে যে দিকে যাবে বলে পরিকল্পনা করেছিল সে অঞ্চলের কিছু কিছু ভাষা আগে থেকে রপ্ত করার প্রচেষ্টায় থাকতেন। এই প্রবণতাকে শেক্সপিয়ার পন্ডিত অস্ট্রেলিয়া নিবাসী জন গিলিস ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘শেক্সপিয়ার এ্যান্ড দ্য জিওগ্রাফি অব ডিফরেন্স’ গ্রন্থে পোয়েটিকএম্প্যায়ার বা কাব্যিক সাম্রাজ্য হিসেবে আখ্যা দিলেন। অর্থাৎ প্রাচীন ইতিহাসবিদ প্লিনি, হিরোডোটাস এমন কি প্লুটার্ক পর্যন্ত এ ধারণা ব্যাপকতা পায় যে রাজ্যের পরিসর বাড়ান একটি অবধারিত দায়িত্ব। প্রথম রানি এলিজাবেথের রাজত্বকালে (১৫৫৮-১৬০৩) ইংল্যান্ডের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে এই ধারণা স্থিরবদ্ধ হয় যে ১৫৮৮তে পরাশক্তি স্পেইনকে দ্য গ্রেট আর্মাডা যুদ্ধে পরাস্ত করার পর ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ না করে আর উপায় নেই। রানির মন্ত্রণাসভার অন্যতম অমাত্য জন ডি জোর দিয়ে বললেন যে, ‘দিস ইংল্যান্ড মাস্ট বি এ্যান এম্প্যায়ার।’ এই চিন্তারই ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন করেন রবার্ট ক্লাইভ। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, রবার্ট ক্লাইভ যখন মীর জাফরের সঙ্গে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলেন, তখন তাঁরা কীভাবে আলোচনাটা শুরু করেছিলেন। বুঝলাম দোভাষীর মাধ্যমে। কিন্তু রবার্ট ক্লাইভের আগে ভারতবর্ষে যে ইংরেজরা প্রথম এসেছিল, কিংবা যে পর্তুগীজেরা প্রথম নেমেছিল তাদের সাথে ভারতীয়দের সঙ্গে আদি যোগাযোগটা কীভাবে হয়েছিল! তখনতো দোভাষীকুলের সৃষ্টি হয় নি।
এই যোগাযোগটা আসলে হয় ভাষাহীনতার মাধ্যমে। অর্থাৎ মুখের ভাষার জায়গা দখল করে নেয় শারীরিক ভাষা ও আরও পূর্ণতর অর্থে সাংকেতিক ভাষা। এখানে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনটা যেভাবে মিটতে পারে সেভাবেই ভাষার মাধ্যমে কিংবা ভাষাহীনতার মাধ্যমে যোগাযোগটা প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন লোক সড়ক দুঘর্টনায় পতিত হলে তাকে সাহায্যকারী পথচারীদের যেমন লোকটি কোন ভাষায় কথা বলে সেটি তাৎক্ষণিকভাবে জানার প্রয়োজন হয় না, তেমনি ক্লাইভ যখন কলকাতায় মীরজাফরের বাগানবাড়িতে তাঁর সঙ্গে ষড়যন্ত্র পাকাতে ব্যস্ত, তখন নানানভাবে মুখের ভাষায় এবং শরীরের ভাষার মাধ্যমে কিংবা মানচিত্র, বন্দুক, বা নানাবিধ বস্তু প্রদর্শনের মাধ্যমে যোগাযোগটি স্থাপিত হয়েছিল! অর্থাৎ, সুরেলার ‘টে’ ভাষাটি কোনো না কোনোভাবে কার্যকর ছিল।
এই ধরনের ঐতিহাসিক যুগ্মতা কিংবা মুখোমুখিনতার সময় ভাষা কীভাবে কাজ করে তার বহু উদাহরণ চলচ্চিত্রে পাওয়া যায়। যেমন আমেরিকার ভিত্তিতেই কথাটা বলা যায়। বহু ওয়েস্টার্ন ছবির মধ্যে যখন শ্বেতাঙ্গ অভিবাসী আর রেড ইন্ডিয়ান গোত্রগুলির মধ্যে সংঘর্ষের চিত্র দেখান হয়, তখন সমঝোতার জন্য দোভাষীর কোন চরিত্রের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। মূলত হলিউডের নাম করা ছবিগুলিতে গল্পের নায়ককেই দেখা যায় একইসাথে ইংরেজি, যেটা তার মাতৃভাষা, আর আমেরিকান আদিবাসীদের ভাষা জানতে। যেমন ১৯৭০ সালে নির্মিত ‘লিটল বিগ ম্যান’ ছবিতে জ্যাক ক্র্যাবের চরিত্রে অভিনয় করার সময় ডাস্টিন হফম্যান শায়ান গোত্রীয় ভাষায় কথা বলেন, কারণ কাহিনীতে সে গোত্রের মধ্যেই ছিনতাইকৃত হয়ে তিনি শিশুবয়স থেকে বড় হয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে নির্মিত ‘ডান্সেস উইদ উলভস’ ছবিতে লে. জন জে ডানবারের চরিত্রে অভিনয়কারী কেভিন কসনারকে সিউক্স গোত্রের ল্যাকোটা ভাষা শিখতে দেখা যায়। জেইমস ফেনিমোর কুপারের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট অব দ্য মোহিকানস’-এর চলচ্চিত্রে ভাষ্যে (১৯৯২) হকির চরিত্রে রূপদানকারী ড্যানিয়েল ডে লুইসকে এ্যালগোনকিয়ান ভাষায় মোহিকানদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়।
ভাষার সংমিশ্রণতা বিপরীত সংস্কৃতির মধ্যে ভাব আদান প্রদানে সহযোহিতা করে। হিউমারের রাজা শেক্সপিয়ার যেমন ঐতিহাসিক নাটক লিখেছেন, তেমনি ইতিহাসের ভিতর প্রচুর স্বকল্পিত মজার মজার মিশেল দিয়েছেন। ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অবসান হয় একটি সুবিধাজনক রাজনৈতিক বিবাহের মাধ্যমে। ফ্রান্সের রাজা ষষ্ঠ চার্লসের রাজকুমারী ক্যাথেরিনকে বিয়ে করবেন ইংল্যান্ডের রাজা ৫ম হেনরি। হেনরি ফরাসী জানেন না, আর ক্যাথেরিন ইংরেজি জানেন না। তখন ক্যাথেরিনকে দেখা যায় শিক্ষিকা নিয়োগ দিয়ে ইংরেজি শিখতে। ক্যাথেরিন শিখছেন (আর দর্শক এবং পাঠক মজা পাচ্ছেন।) ইংরেজি ভাষায় নখকে কী বলে, ঘাড়কে কী বলে, হাতকে কী বলে, বাহুকে কী বলে, আঙ্গুলকে কী বলে, ইত্যাদি। প্রতিবারই তাঁকে শুধরে দেওয়া হচ্ছে, আর প্রতিবারই তিনি ভুল উচ্চারণ করছেন। এর মধ্যে বিখ্যাত এজিনকো যুদ্ধ হয়ে যায় (১৪১৫)। ফরাসীরা পরাজিত হয়। বীরের বেশে হেনরি তাঁদের বাসরশয্যায় প্রবেশ করেন। কিন্তু ভাষাগত সমস্যার জন্য রোমান্স বেশীদূর এগোতে পারে না। শেষমেষ হেনরি বিরক্ত হয়ে বলেন, কেইট তুমি কেন আমাকে এই বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলছো, আমার না আছে শব্দের ওপর দখল, না আছে ছন্দজ্ঞান, তোমার ফরাসী ভাষা শেখার চেয়ে অনেক সহজ আমার জন্য ঘোড়ায় লাফ মেরে উঠে কোন রমণীকে পিঠের ওপর সওয়ার করে বৌ বানানো। আমি কেবল সৈনিক, সেভাবেই দেখ আমাকে। (রাজা হেনরি পঞ্চম, পঞ্চম অংক, দ্বিতীয় দৃশ্য, ১৩১-১৬৭)।
ভাষার তারতম্যে রোমান্সে সামান্য বেগ পেতে হলেও সেটি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভাষার তারতম্য যোগাযোগকে মসৃণ না করে প্রতিপক্ষতামূলক করে ফেলতে পারে। যেমন শেক্সপিয়ারের যে নাটকটিকে সাধারণত ঔপনিবেশিকতা যুগের প্রাক-টেক্সট ধরা হয় সেই ‘দ্য টেম্পেস্ট’ (১৬১১) নাটকে ঔপেনিবেশিক যুগের আদি কাল্পনিক পিতা প্রসপেরো ক্যালিবানের দ্বীপ দখল করেন, আর তাকে তাঁর মেয়ে মিরান্ডাকে ধর্ষন করার প্রচেষ্টার অভিযোগে ভৃত্যে পরিণত করেন, এবং তাকে তাঁর ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদী ভাষায় প্রশিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করেন। তখন একদিন ক্যালিবান প্রসপেরোর মুখের ওপর বলে যে ‘তুমি আমাকে তোমার ভাষা শিখিয়েছো, আর এতে আমার উপকার হলো যে আমি তোমাকে তোমার ভাষায় গালি দিতে পারি’ (প্রথম অংক, দ্বিতীয় দৃশ্য, ৩৬৪-৬৬)। এই বাক্যটি নাটকটির অনেক সংস্করণে ক্যালিবান মিরান্ডাকে বলতে দেখা যায়, কারণ ক্যালিবানকে ভাষা শেখানোর দায়িত্ব মিরান্ডার ওপর বর্তেছিল।
‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের একশত আট বছর পরে ১৭১৯ সালে প্রকাশিত ড্যানিয়েল ডিফোর কালজয়ী ভ্রমণোপন্যাস, কিন্তু বর্তমানে বিতর্কিত, ‘রবিনসন ক্রুসো’তে দেখা যায় রবিনসন যে স্থানীয় লোককে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তাকে নতুন নাম দিলেন ফ্রাইডে বা ম্যান ফ্রাইডে, এবং তাকে খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করলেন ও ইংরেজি ভাষা শেখালেন। এখন উত্তরাধুনিক পরিস্থিতিতে এই উপন্যাসটির সমালোচনা করা হয় এ জন্য যে এটিতে প্রভাবশালী সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাহাত্ম্য গাওয়া হয়েছে অযাচিতভাবে।
আজকে ভাষা নিয়ে আমার আলোচনার শেষ প্রসঙ্গ হলো ৭১২ খ্রীস্টাব্দে উমায়া বংশের নৃপতি খলিফা আল ওয়ালিদের নির্দেশে তরুণ সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাশিম সিন্ধু বিজয় কার্যকর করেন। কাশিমের ভাষা ছিল আরবি। তাঁর বিজয়ের ফলে ভারতবর্ষে ইসলাম যুগের শুরু হলেও আজ পর্যন্ত এতদঞ্চলে আরবি কেবলই একটি ধর্মের ভাষা হিসেবে প্রচারিত ও প্রসারিত হবার ফলে, কিন্তু এটিকে আর অন্য দশটি ভাষার মতো কেজো ভাষাতে বিবেচনা না করার ব্যর্থতায়, আরবি ধর্মবিষয়ক কার্যাবলীর বাইরে এখনও আমাদের কাছে একটি অন্যতম দুর্বোধ্য বিদেশী ভাষা।
যেখানে ভাষার দুর্বোধ্যতা যোগাযোগের বিঘœ ঘটাবে সেখানে সুরেলার ‘টে’ সিনড্রোম থাকবেই।