আঞ্চলিক বন্দরের পথে এগুচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর

১৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

ভূঁইয়া নজরুল <<
১৩৩ বছর আগে দুটি জেটি দিয়ে চালু হওয়া চট্টগ্রাম বন্দর এখন আঞ্চলিক বন্দরের স্বপ্ন দেখছে। প্রতিষ্ঠাকালীন চট্টগ্রাম বন্দর শুধু কর্ণফুলী নদী কেন্দ্রীক থাকলেও এখন বঙ্গোপসাগর ঘিরে বন্দর ও টার্মিনাল (হালিশহর প্রান্তে বে টার্মিনাল, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর, সীতাকুণ্ডে জেটি এবং মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পৃথক বন্দর) নির্মাণের মাধ্যমে আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে চলছে। আর সরকারের নানাবিধ পরিকল্পনাও এক্ষেত্রে সহায়ক হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার নানা উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও প্রফেসর এমিরেটস ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘একসময় কর্ণফুলী ঘিরে চট্টগ্রাম বন্দর গড়ে উঠলেও এখন আর সেদিন নেই। বর্তমানে হালিশহর প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের তীরে গড়ে উঠছে বে টার্মিনাল, পাশাপাশি নির্মিত হচ্ছে মাতারবাড়ি বন্দর। বৃহৎ এই দুই প্রকল্পের পাশাপাশি সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ে সরকার টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা আমাদের পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে পণ্য সরবরাহ করতে পারবো এবং আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে গড়ে তুলতে পারবো।’
সরকারের আরেকটি পদক্ষেপকে সঠিক আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে সরকার পায়রা থেকে সরে আসা ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। গভীর সমুদ্র বন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ি।
করোনাকালেও গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর ২৮ লাখের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করে। কনটেইনার হ্যান্ডেলিং প্রতিবছর বৃদ্ধির কারণে ২০০৯ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ৯৮তম স্থানে ছিল। ২০১৯ সালের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের উপর ভিত্তি করে গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর ৫৮তম স্থানে উন্নীত হয়। আগামীতে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিং আরো বাড়বে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর এখন আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে গড়ে উঠছে। আমাদের দেশ ছাড়াও পাশ্ববর্তী দেশগুলোর চাহিদা পূরণে সক্ষমতা অর্জন করছে চট্টগ্রাম বন্দর।’
তিনি আরো বলেন, মিরসরাই থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের পোর্ট লিমিট হওয়ায় মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বে টার্মিনাল উভয়ই চট্টগ্রাম বন্দরের আওতাভুক্ত। এগুলোর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আগামীতে আরো বাড়বে।
১৩৩ বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দর দুটি জেটি দিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও দীর্ঘ এই পথচলায় চট্টগ্রাম বন্দর অনেক এগিয়েছে। এখন চট্টগ্রাম বন্দর নিজেকে আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে গড়ে তুলছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন,‘ আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে গড়ে উঠতে সবার আগে বে টার্মিনালকে প্রস্তুত করতে হবে। বে টার্মিনাল ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। বে টার্মিনাল চালু হলে উন্নয়নের গতি বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।’
কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের এই এগিয়ে চলায় মেরিটাইম সেক্টরে দক্ষ জনবলের যোগান পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান ও বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবালের সঙ্গে। তিনি বলেন,‘ মাতারবাড়ি বন্দর হবে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ আশপাশের দেশগুলোর জন্য একটি হাব। আগামীর প্রয়োজনে এই বন্দরের পাশে আরো অনেক জায়গা রয়েছে। সেসব জায়গায় প্রকল্প নেয়া যাবে। একইসাথে দেশের মেরিটাইম সেক্টরকে এগিয়ে নিতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগামী সাত থেকে আট বছর পর থেকে নিয়মিতভাবে গ্র্যাজুয়েট বের হবে।’
তিনি আরো বলেন, নিয়মিত গ্র্যাজুয়েটদের পাশাপাশি আমরা প্রফেশনালস এবং বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের জন্য এক বা দুই সপ্তাহের বিভিন্ন কোর্স চালু করেছি। এরমাধ্যমেও আমরা মেরিটাইম সেক্টরে আমাদের বিদ্যমান জনবলকে দক্ষ করে তুলছি।
এদিকে সম্প্রতি মাতারবাড়ি বন্দরে গিয়ে দেখা যায়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য মাতারবাড়ি বন্দরের জন্য ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল প্রস্তুত। ইতিমধ্যে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের ইক্যুইপমেন্ট নিয়ে জাহাজ ভিড়ছে। মাতারবাড়ি বন্দরের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন,‘ বন্দর নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বর্তমানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য কাজ করছে। তাদের পরিকল্পনা হাতে পেলেই দরপত্র আহ্বানসহ অন্যান্য কাজ শুরু করা হবে।’
তিনি আরো বলেন, মাতারবাড়ি বন্দর হবে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক হাব। আর তা করতে গিয়ে আশপাশের বন্দরগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায়ও নামতে হবে। মাতারবাড়ি বন্দরের সেই সক্ষমতাও রয়েছে। সরকারের আঞ্চলিক পরিকল্পনাগুলো সঠিক পথেই এগুচ্ছে। সব মিলিয়ে বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে মাতারবাড়ির।
উল্লেখ্য, ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে কর্ণফুলীর তীরে দুটি অস্থায়ী কাঠের জেটি নির্মিত হয়। পরবর্তীতে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশন গঠিত হয়। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি মুরিং জেটি নির্মিত হয়। একই বছরের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার কার্যকর হয়। আর এই তারিখকে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই আলোকে আজ ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৪তম প্রতিষ্ঠা দিবস। দীর্ঘ এই পথচলায় চট্টগ্রাম বন্দর নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল, চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করে এবং এখন নির্মাণ করছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল।