অহি উল্লাহর আঁকা শেষ ছবি

আরিফুল হাসান »

খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নয় বছরের একটি বালক। তার মনটি আপাত বিক্ষিপ্ত। জন্মের পরে এমন ঘনঘোর আর কখনো দেখেনি সে। মানুষেরা কী এক আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। মাঝে-মাঝে দুয়েকটা গাড়ি ভয়ে-ভয়ে যেন ছুটে যাচ্ছে। যেন ভয়ানক কিছু বয়ে গেছে দেশটার ওপর দিয়ে। কিন্তু দেশটা বলতে সে কতটুকু চেনে? বালক বয়েসে মায়ের কোল ছেড়ে সবে পড়াশোনা আরম্ভ করেছে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এই পড়াশোনা, এই আসা যাওয়ার মাঝে সে টের পায়, ঢাকায় একটা বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কী ঘটতে যাচ্ছে, তা তার অবুঝ জ্ঞানে ধরতে পারে না। তবু পিতার শুকনো মুখ, মায়ের আতঙ্কিত মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারে, কোনো ভালো কিছু ঘটতে যাচ্ছে না।
স্কুল বেশ ক’দিন ধরেই বন্ধ। কিন্তু এ বন্ধের মধ্যেও একদল ছেলেমেয়ে গোপনে স্কুলে যায়। অহি উল্লাহরও যেতে মন চায়। কিন্তু বাবা-মা দেয় না। বাইরে নাকি গ-গোল, আর এই গ-গোলের সময় স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। পিতা সাফ-সাফ জানিয়ে দিয়েছে। মা-ও কোলছাড়া করতে চায় না। একটু নজরের আড়াল হলেই ভয়ে মায়ের কলিজায় পানি থাকে না। কিন্তু স্বভাব যার প্রজাপতির মতো, তাকে কি বেঁধে রাখা যায়? অহিউল্লাহ কথা শোনে না। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে-হাঁটতে ফুল পাখি প্রজাপতি চলন্ত রিকশা রিকশাওলার ঘর্মাক্ত দেহ আঁকে সে। কোনো নতুন একটি গাড়ি আসলে সেটি সে কাগজে-পেনসিলে ধরে রাখার চেষ্টা করে।
এই আঁকাআঁকির অভ্যেসটা তার মগজে গেঁথে গেছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল নিয়ে সারাদিন শহরের অলিগলি ঘোরেআর যেখানে চোখ আটকে যায়সেটিরই দৃশ্যপট এঁকে ফেলা অহিউল্লার কাজ। পিতা দরিদ্র মানুষ। গা-খাটা রাজমিস্ত্রি। যেখানে যেদিকে কাজ পায় সেদিকেই যেতে হয়। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত মো. হাবিবুর রহমান। ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে বড় মানুষ করতে চায়। ছেলেও পড়াশোনায় বেশ ভালো। আগ্রহীও বটে। তবে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তার ছবি আঁকায়। ফলে বাবা-মাও ছেলের এ স্বভাব সম্পর্কে জানে এবং রীতিমতো প্রশ্রয়ও দেয়। হাবিবুর রহমান বলেছে, আর কিছুদিন পরে অহি উল্লাহকে রং পেনসিল কিনে দেবে। রঙিন একটি খোয়াব অহিউল্লাহর মাথার ভেতর খেলে। ঢেউ তুলে তার বালকমনে। মনের অজান্তে সে কতকিছু এঁকে ফেলে! আবার সেগুলোকে মুছেও ফেলে মনে-মনে। সকালের সূর্য, পূর্ণিমার চাঁদ, হাঁসের হলদে ঠোঁট, রঙধনুর সাতরঙ সে আঁকে। আঁকে একটি ভোর, একটি টগবগে দুপুর।
সেদিনও সকাল বেলা মা তাকে বাইরে যেতে দেয় না। পিতা হাবিবুর রহমানও আজ কাজে যায়নি। সকালে ঘরে নাশতা বানানোর মতো পর্যাপ্ত আটা না থাকা সত্ত্বেও ঘর থেকে বের হয়ে ১৫২ লুৎফর রহমান লেনের গলির মুখে মুদি দোকান থেকে আটা আনতে যায় না তার বাবা। অজানা এক আতংকে ঘরের মধ্যেই কুঁকড়ে থাকে সবাই। অহিউল্লার এই অবরুদ্ধতায় দমবন্ধ হয়ে আসে। সে শোনে, গলির মোড়ে দোতালা বিল্ডিংটার বারান্দার টবে ফোটা ফুলগুলো তাকে ডাকছে। ফুলে-ফুলে উড়ে চলা প্রজাপতিগুলো তাকে ডাকছে। গলির মুখে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো তিনচারটি পথকুকুর তাকে ডাকছে। এসবের ডাক সে অবজ্ঞা করে কীভাবে?কিন্তু কীভাবে সে ঘর থেকে বের হবে!পিতার শাসন, মায়ের সুতীক্ষè দৃষ্টি, এসবকে ফাঁকি দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ার সুযোগ পায় না।
বেলা বাড়ে। আস্তে-আস্তে দুয়েকজন বের হতে থাকে। রাস্তায় একটা-দুটো গাড়ি ভয়ে-ভয়ে চাকা ঘোরায়। মিলিটারিরা রাস্তা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে নাকি। গতকাল নাকি মেডিকেলের সামনে গোলাগুলি হয়েছে। অনেক ছাত্ররা নাকি নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে অসংখ্য। ভাষার দাবিতে এ মিছিল। বালক অহিউল্লাহ ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। ভাষার আবার দাবি কী? কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় কে এল জুবিলি স্কুলের শিক্ষক কামরুজ্জামান যখন এলাকায় এসে কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রের সাথে কথা বলছিলেন তখন অহি উল্লাহও সেখানে ছিল। সেখানে ছিল বলতে একটু দূরে একটা আমগাছের নিচে কয়েকটা পথকুকুরের সাথে খেলা করছিল সে। পশ্চিমের লাল আকাশ বুকে নিয়ে কামরুজ্জামান স্যার ছাত্রদের বলছেন, মিছিলে গুলি হয়েছে। স্পট ডেথ সাতজন। হয়তো আরও বেশি। পুলিশ অনেকের লাশ গুম করে ফেলেছে। আহত হয়েছে অনেকে। এবারে আন্দোলনে যেতে হবে। অলিগলি সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে বিদ্রোহের আগুন।
অহিউল্লাহ আন্দোলনের আগুন দেখে, দেখে চকচক করে কামরুজ্জামান স্যারের চোখ। এই ছায়া-ছায়া অন্ধকারেও। সে শোনে, মায়ের ভাষায় কথা বলতে দেবে না ওরা। সে শোনে, তার পাখির ভাষা, তার ফুলের ভাষা সব মূক হয়ে যাবে। সে ভয় পায়। আবার মনে-মনে জ্বলেও ওঠে। শোনে, মিছিলে যাবে ছেলেরা আগামীকাল সকালে। রাতটা তার কোনোরকম কাটে। কিন্তু এই সকালে রাস্তাভর্তি পুলিশ, পাকিস্তানি সৈনিক, জলপাই রঙের ট্যাঙ্কের ভয়ে বাইরে যাবার ব্যাপারে বাবা মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞা তার মনখারাপ করে দেয়। সামান্য নাশতা করে মুখভার করে সে বসে থাকে। ক্রমশ লোকজন বেরুতে থাকলে এক ফাঁকে সেও বেরিয়ে পড়ে বাবা-মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে।
রাস্তাটা এত সুনসান! কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে বুকের ভেতরটা। তার পরিচিত তিন-চারটি কুকুর পথের একপাশে আমগাছটার গোড়ায় শুয়ে আছে। তাকে দেখে একটা কুকুর মাথা উঁচু করে একবার হাই তুলে। তারপর আবার মাথা নামিয়ে শুয়ে যায়। অহি উল্লাহ একপলক থামে। পকেট থেকে কাগজ-পেনসিল বের করে এঁকে ফেলে তিনটা কুকুরের শুয়ে থাকা। তারপর তার চোখ যায় দোতলা বাড়িটির ঝুলবারান্দার দিকে। সারি-সারি টবে বাহারি রকমের ফুল ফুটে আছে। একটি বড় রক্তজবা ঝুঁকে আছে বারান্দা থেকে নিচের দিকে। তাতে এসে একটি প্রজাপতি পাখা মেলে বসে। ফুলের কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু হয়তো বলছে সে। অহিউল্লার ভালো লাগে বিষয়টি। সে ফুল ও প্রজাপতির ছবি আঁকে।
তারপর সে ১৫২ লুৎফর রহমান লেন ছেড়ে ওঠে যায় নবাবপুর রোডে। থমথমে একটা পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো রাস্তাজুড়ে। লোকজন উৎকণ্ঠা নিয়েও বাইরে বেরিয়ে এসেছে এবং কি যেন একটা ঘটতে যাচ্ছে, এমন একটা নিভৃত চাঞ্চল্য বিরাজ করছে সবখানে। তার বালকমনে এতকিছুর ব্যাখ্যা মেলে না। তবে কামরুজ্জামান স্যারের কথাটা তার মনে আছে। আজ সকালে মিছিল বের হবে। ভাই হত্যার প্রতিবাদে মিছিল। অহিউল্লাহর একান্ত ইচ্ছে সেও মিছিলে যোগ দেবে। সে এগুতে থাকে। কিন্তু খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। রাস্তা জুড়ে জলপাইরঙের ট্যাংক নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যেরা দাঁড়িয়ে আছে। শিশু অহিউল্লাহর চোখে এ রকম উর্দিপরা মানুষ এই প্রথম দেখা। তাদেরকে তার মানুষ বলে মনে হয় না। তার মনে হয়, একদল জন্তু-জানোয়ার হিংস্র নখর আর থাবা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। পকেট থেকে পেনসিল ও কাগজ বের করে সে আঁকতে থাকে ওই অদ্ভুতদর্শন প্রাণিদের। এমন সময় পেছন দিক থেকে অতর্কিতে একটি মিছিল ওঠে আসে নবাবপুর রোডে। অহিউল্লাহর ছবি আঁকা থেমে যায়। কাগজের টুকরোটি মুখে পুরে দৌড়ে গিয়ে যোগ দেয় মিছিলে। হাত উর্ধ্বে তোলে। স্লোগান ধরে। কয়েক কদম সামনে বাড়ে তারা। এমন সময় ঠা ঠা করে ওঠে পাকিস্তানি সৈন্যদের রাইফেল। চোখের পলকে অন্য অনেকের সাথে ওড়ে যায় অহিউল্লার মাথার খুলি। শুধু তার চোয়ালের ভেতর শক্ত করে আটকে থাকে এক টুকরো কাগজ। রক্তের অক্ষরে যাতে একটি ভোর আঁকার স্বপ্ন ছিল।