রেবা হাবিব »
গাজার খান ইউনিস শহরের ঠিক এককোণে একটা ছোট্ট, বালির মতো ধূসর পাড়ায় থাকে সাত বছরের আয়াত। ছোট্ট আয়াতের একটা স্বপ্ন আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো।
ঘরে খাবার নেই, স্কুল নেই, খেলার মাঠ তো বহু আগেই ধুলায় হারিয়ে গেছে। তবু আয়াতের একটা ঘুড়ি আছে। সেই ঘুড়ির নাম ‘নূর’। নূর মানে আলো। তার বড় ভাই মাশরেক একদিন তাকে বলেছিলো,
‘আয়াত, আমরা আলোর ঘুড়ি বানাবো, যেটা আকাশে উঠলেই পৃথিবীর সবাই দেখতে পাবে গাজা এখনো বেঁচে আছে!’ তখন আয়াত হেসেছিলো। সেই হাসি এখন আর আসে না। কারণ মাশরেক এখন নেই।
যুদ্ধের শব্দ আয়াতের জন্য নতুন নয়। কিন্তু মাশরেকের চলে যাওয়া একেবারে অন্যরকম। সে ছিলো আয়াতের আশ্রয়, ছায়া। এখন আয়াত শুধু তাকিয়ে থাকে ছোট্ট উঠানের একপাশের দেয়ালের দিকে, যেখানে মাশরেক খোদাই করে লিখেছিলো-
‘আয়াত, একদিন তুমি ঘুড়ির মতো উড়বে।’
সে দেয়াল এখন ফাটলধরা, তবে লেখাটা এখনো আছে। আর আছে ঘুড়িটা। মাশরেকের হাতের তৈরি। লাল, সবুজ আর সাদা কাপড়ের তৈরি ছোট্ট একটা ঘুড়ি। নিচে জুড়ে দেওয়া একটা ছোট্ট ঝান্ডা ফিলিস্তিনের।
আগে আয়াত স্কুলে যেতো। এখন সে প্রতিদিন খুঁটি গোনে কতটা অবশিষ্ট আছে প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে। তার মায়ের নাম মুনা। মুনা দিনে একবেলা রুটি বানান অন্যদের জন্য, তাতে যে কয়টা বস্তা আটা মেলে সাহায্যকারীদের কাছ থেকে। সে মেয়েকে বলে
‘আয়াত, ঘুড়ির কথা ভাবলে কাঁদিস না। আকাশ একদিন আমাদেরই হবে।’
আয়াত চুপ করে থাকে।
তারপর একদিন সে বলে-
‘মা, আমি ঘুড়ি ওড়াতে চাই। আজ।’
বাড়ির অর্ধভাঙা ছাদে ওঠা এখন একটা সাহসিকতার কাজ। কিন্তু আয়াত ও তার একমাত্র খেলার সাথি দশ বছরের ইয়াসিন, সাহস করে ওঠে। ইয়াসিন তার পাশের ঘরের ছেলে। তার বাবাও নেই।
তারা ঘুড়িটা হাতে নিয়ে দাঁড়ায় ছাদের এক প্রান্তে। বাতাস জোরে বইছে। ওদের ছোট্ট হাত কাঁপছে।
আয়াত বলে, ‘ইয়াসিন, নূর যদি উঠে যায়, তুমি বলবে , মাশরেক দেখছে, তাই না?’
ইয়াসিন মাথা নাড়ে, চোখ মোছে।
ঘুড়িটা ছেড়ে দেয় আয়াত। প্রথমে কিছুটা ঝাঁকুনি, তারপর হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে ওঠে একটা ছোট্ট আশার প্রতীক।
বাড়ির নিচে ছোট ছোট আরও অনেক শিশু তাকিয়ে থাকে ওপরে। সবার চোখে বিস্ময়, কেমন করে এত রঙিন একটা ঘুড়ি এখনো আছে? কেমন করে মাশরেকের বোন এমন সাহস করে উঠেছে?
এক বৃদ্ধা বলেন, ‘এই বাচ্চাটাই হয়তো একদিন বলবে আমাদের গল্প। ঘুড়ির মতো ভেসে বেড়াবে শহরজুড়ে।’
আকাশে তখন দুই ধরনের বস্তু, একটা শান্তিপূর্ণ ঘুড়ি, আরেকটা গর্জন করে চলে যাওয়া যুদ্ধবিমান।
কিন্তু ঘুড়িটা উড়তেই থাকে। ওড়ে, যতক্ষণ না সন্ধ্যার আগের হালকা রোদে এক ফালি রঙ ছুঁয়ে যায় ঘুড়ির গা।
আয়াত তখন বলে, ‘দেখো মা, মাশরেক আজও আকাশে। ও হারেনি। কেউই হারেনি যারা ভালোবাসে।’
পরদিন জাতিসংঘের ত্রাণকর্মী যখন ক্যাম্পে আসে, আয়াত তাকে দেয় একটা ছোট্ট চিঠি, ঘুড়ির কাঠির মাথায় বাঁধা।
চিঠিতে লেখা- ‘আমাদের কথা তোমরা ভুলে যেয়ো না। আমরা এখনো খেলতে চাই। আমরা ঘুড়ি ওড়াতে চাই। আমরা স্কুলে যেতে চাই। আমরা শুধু বেঁচে থাকতে চাই।’
ত্রাণকর্মী কাঁদে। আয়াত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
এক বছর পর, কোনো এক ইউরোপের শহরে আয়াতের চিঠিটা একটা বইয়ের অংশ হয়। আর সেই বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা থাকে- ‘ঘুড়িগুলো যুদ্ধ বোঝে না। তারা শুধু আকাশ চেনে। আয়াত আমাদের সেই আকাশ দেখিয়েছে।’