রুশো মাহমুদ »
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের জেলা কক্সবাজার। এখানে এক মহাপরিকল্পনা সামনে রেখে দিনরাত চলছে অবকাঠামো নির্মাণের কর্মযজ্ঞ।
কক্সবাজার জেলার অর্ন্তগত মহেশখালি দ্বীপ উপজেলা। সবচেয়ে বড় নির্মাণযজ্ঞটি হচ্ছে এই এলাকায়। দ্বীপ উপজেলার অনেকটা অপরিচিত জায়গা মাতারবাড়ী ও ধলঘাট ইউনিয়ন। একসময়ের অবহেলিত অঞ্চল। সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ এলাকা হিসেবেই বেশি পরিচিত। সাগরের পানিতে ড়ুবে থাকা জলাশয় আর বিস্তীর্ণ জায়াগা জুড়ে লবণের ক্ষেত ছাড়া তেমন কিছুই ছিলো না। এখন লাখ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে এখানে। গড়ে তোলা হচ্ছে এ অঞ্চলের ট্রানশিপমেন্ট বন্দর এবং দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর।
দেশে বাড়তি গভীরতায় জাহাজ ভেড়ানোর টার্মিনালের প্রয়োজনীয়তা অনেকদিনের। তারই সূত্র ধরে বিভিন্ন সরকারের আমলে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। বাংলাদেশের মতো একটা গরীব দেশের পক্ষে এই ব্যয়বহুল প্রকল্প করা সম্ভব কি না তা নিয়েও চলে দোলাচল।
২০০৯ সালে কার্যকর উদ্যোগটি নেওয়া হয়। ওই বছর জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল নয়টি সম্ভাব্য এলাকা পরিদর্শন করে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুপারিশ করে সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়। ২০১২ সালে সরকার সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ২০১৬ সালে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার সময় ধরা হয়। অর্থায়ন করার আলোচনা চলছিল চীনের সঙ্গে। অবশ্য ২০১৪ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে নির্ধারিত সমঝোতা স্মারক সই হয়নি।
ভূ-রাজনীতির শিকার সোনাদিয়ায় অনিশ্চয়তার মধ্যেই পটুয়াখালীর পায়রায় সরকার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দেয়। তবে তখনো সমীক্ষা হয়নি। পরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়েলিংফোর্ডকে দিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করানো হয়। এরপর ১ হাজার ৮৩৪ কোটি ডলার বা প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা) খরচ ধরে প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়। এতে এটি দাঁড়ায় বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বন্দর প্রকল্প।
এদিকে জাপান নিয়ে আসে ‘বিগ বি’ ধারণা। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে জাপান সরকারের প্রস্তাবিত বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ (বিগ-বি) ইনিশিয়েটিভ যা বিগ-বি নামে পরিচিত। ইতিমধ্যে এই উদ্যোগের আওতায় তৈরি হচ্ছে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প। বিগ-বির প্রধান তিনটি স্তম্ভের একটি এটি। ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ – এই কৌশলগত পরিকল্পনায় এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বন্দর, যোগাযোগ, শিল্পাঞ্চলসহ সমন্বিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের কথা বলা হয়।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে ‘বিগ বি’ উদ্যোগের ঘোষণা দেন। এর বাস্তব রূপ দিতে দেশটির উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ২০১৬ সালে একটি জরিপ করে মাতারবাড়ীতে বন্দর নির্মাণের পরামর্শ দেয়।
২০১৮ সালে পায়রায় প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের ঘোষণা দেন সে সময়ের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তবে বিশেষজ্ঞরা নির্মাণ এবং নদীর পলি অপসারণে বিপুল ব্যয়ের কারণে এ প্রকল্প নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। এখন আর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে না, হচ্ছে শুধুই সমুদ্রবন্দর।
ব্যস্ততম চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ সম্পাদিত হলেও, এই বন্দরের জাহাজগুলোকে ব্যবহার করতে হয় অন্য দেশের ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট। কারণ বড় জাহাজগুলো চট্টগ্রামে ভিড়তে পারে না। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, যেখানে ভিড়তে পারবে ১৬-১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। অর্থাৎ সবচেয়ে বড় জাহাজও নোঙর করতে পারবে এই বন্দরে। একসঙ্গে পরিবহন করা যাবে ১০-১২ হাজার টিইইউএস কন্টেনার পণ্য। ২০২৬-২৭ সালের মধ্যে এই বন্দর চালু হবে বলে আশা করা যায়।
বড় জাহাজে একসঙ্গে বেশি পণ্য এলে এবং সরাসরি পণ্য পাঠাতে পারলে বন্দরে জাহাজের অপেক্ষার সময় কমে যাবে। বাংলাদেশ নিজেই হবে একটি ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টের মালিক। এতদিন বাংলাদেশ ব্যবহার করেছে অন্য দেশের বন্দর। আর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর হবে রিজিওনাল পোর্ট, বাংলাদেশের অন্যান্য বন্দর যেমন সুবিধা পাবে তেমন প্রতিবেশী দেশও তাদের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে।
এককথায়, গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মহেশখালীর মাতারবাড়ী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ‘পাওয়ার অ্যান্ড পোর্ট হাব’। জল, স্থল এবং রেলপথে সংযুক্ত থাকবে মাতারবাড়ী।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যর লীলাভূমি কক্সবাজার। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগও স্থাপন হয়ে গেছে। পর্যটন নগরীর সঙ্গে অবিরাম যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন শুধু সড়কপথের ওপর আর নির্ভর করবে না। আকাশপথেও হচ্ছে উন্নয়নের বড় প্রকল্প। কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখানে দেশের সবচেয়ে বড় রানওয়ে তৈরি করা হয়েছে।
কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা সরাসরি কক্সবাজারে আসা-যাওয়া করতে পারবেন। জ্বালানি হাব হিসেবে ফুয়েল নিতে এখানে অবতরণ করবে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী বিমানগুলো। বিভিন্ন দেশের যাত্রীদের ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠবে কক্সবাজার বিমানবন্দর।
পর্যটনের বিকাশ ও গভীর সমুদ্র বন্দর কেন্দ্রিক বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা সামনে। পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, হংকরংসহ দ্বীপভিত্তিক অর্থনৈতিক হাবগুলোর আদলে গড়ে তুলতে কক্সবাজার ঘিরে এক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার।
কক্সবাজার ঘিরে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে বিমানবন্দর, রেললাইন, ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এসপিএম প্রকল্প, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল এক এক করে চালু হলে পাল্টে যাবে কক্সবাজারের চিত্র। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে মহেশখালী ইকোনমিক জোন দ্বীপভিত্তিক বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপ নেবে।
কক্সবাজারের দূর্গম দ্বীপ মাতারবাড়িতে ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ল্যান্ডবেইজ এলএনজি টার্মিনাল, চারটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন স্থাপনসহ অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে। অঞ্চলটি ইতোমধ্যেই জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য আকষর্ণীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
কক্সবাজারের পর্যটনকেন্দ্রিক বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও বিদেশি পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করতে সাবরাং, নাফ ও সোনাদিয়ায় তিনটি ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের কাজও চলছে। স্বাধীনতার পর অবকাঠামো ও বিনিয়োগে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান কক্সবাজারজুড়ে প্রায় ২৫টি মেগা প্রকল্পসহ ৭৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে, যা পাল্টে দেবে জেলার রূপচিত্র।
কক্সবাজারের ঘিরে সরকারের যেসব প্রকল্প চলমান রয়েছে, বৃহৎ অংকের এই বিনিয়োগে বাস্তবায়ন হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই সাবরাং থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত সমগ্র এলাকা পুরোপুরি বদলে যাবে।
কক্সবাজারের মাতারবাড়ি হবে বাংলাদেশের ইকোনমিক গেম চেঞ্জার। আর কক্সবাজার হবে দক্ষিণ এশিয়ার বিজনেস হাব। কক্সবাজার কেন্দ্রিক মহাপরিকল্পনা বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির সমীকরণ।