সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে ৭ বছরে ‘পথের পাঁচালি’

হুমাইরা তাজরিন »

কয়েক বছর আগেও তারা স্টেশনে হাত পেতে টাকা চাইতো। স্কুলে পাঠানোর ভাবনা তাদের অভিভাবকেরা বাদ-ই দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ‘ভারসাম্যহীনতা’ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের চক্ষুশূল হতে লাগলো। বিবেক তাদের তাড়িত করলো এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কিছু করার। নিজ অবস্থান থেকে এই শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশে শিক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে গড়ে তুললেন ‘পথের পাঁচালি’ নামক সংগঠনটি। সংগঠনটির স্লোগান হলো ‘মুকুলে না ঝরে প্রষ্ফুটিত হোক জ্ঞানের আলোয়’।

শুরুটা হয়েছিলো ২০১৬ সালের মে মাসে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশনের বস্তির এইসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সম্পর্কে ফরেস্ট্রি রোডে বন্ধুদের আড্ডায় আলোচনা চলছিলো। ওদের জন্য কিছু করতে বন্ধুরা একবাক্যে রাজি। শুরুতে নির্ধারিত হলো মাসিক ২০ টাকা করে চাঁদা দেবেন সদস্যগণ। পরদিন থেকেই চাঁদা তোলা শুরু। একমাসের মধ্যে কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করে শুরু হলো শিক্ষার্থী সংগ্রহের পালা। শিশুদের অভিভাবকদের রাজি করানোই ছিলো বড়ো চ্যালেঞ্জ। কিন্তু পর পর সমাবেশ করে অভিভাবকদের সম্মতি নিয়েই নিলেন তারা। এবার চাই প্রাতিষ্ঠানিক সংযুক্তি। শুরুতে ৩৫ জন শিশুকে পার্শ্ববর্তী কুলালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো চাই। কিন্তু অধিকাংশ শিশুদের জন্মনিবন্ধন নেই। এমনকি তাদের পিতা-মাতারও নেই জাতীয় পরিচয়পত্র। কারণ চট্টগ্রামের বাইরে থেকে এসে চবির এই স্টেশন সংলগ্ন বস্তিতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তারা। বেশিরভাগ অভিভাবকই করেন দিনমজুরের কাজ। এবার দীর্ঘ সময় নিয়ে অভিভাবকদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা করে যোগাড় হলো প্রয়োজনীয় সকল কাগজ। ডিসেম্বর আসতেই শিক্ষার্থীরা স্কুলে ভর্তি হলেন।

মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগঠনের সদস্যদের থেকে উত্তোলনকৃত চাঁদা দিয়ে শিশুদের বাৎসরিক শিক্ষা সামগ্রী কেনা হলো। এছাড়া সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার বিকাল বেলা সময়টা নির্ধারিত হলো এই শিশুদের পাঠদানের জন্য। শুরুতে সংগঠনের ৩ জন সদস্য প্রতি পাঠদানে অংশ নেন।

২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা সামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনের কর্মকা-ের সূচনা হয়। ত্রিপল বিছিয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মেই চলতে থাকে পাঠদান।

সেই ‘পথের পাঁচালি’ প্রতিষ্ঠার সপ্তম বর্ষে এসে ২৫১তম পাঠদান সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিশুরা উর্ত্তীণ হয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ৩০ জন শিশুর সংগঠন দাঁড়িয়েছে ৭০ জনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী মিলিয়ে বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৭০জন। শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিবার পাঠদানে অংশ নিচ্ছেন আগের চেয়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৬ জন শিক্ষক। পাঠদান পরবর্তী শিক্ষার্থীদের মাঝে নাস্তাও বিতরণ করে ‘পথের পাঁচালি’। তাদের সকলের হাতে খড়ি দিয়েছে পথের পাঁচালি। এখন আর তারা হাত পাতেনা। নিজের নাম লিখে, অংক কষে এবং ইংরেজি আওড়ায়।

পথের পাঁচালির তালিকাভুক্ত শিশু জান্নাতুল ফেরদৌস পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। শুক্রবার স্টেশনে পড়তে আসলে তার সাথে কথা হয়, জান্নাতুল বলেন, ‘আমি একেবারে শিশু শ্রেণি থেকে পথের পাঁচালিতে পড়ছি। আমার মা তো অন্য বাড়িতে কাজ করেন। আমাদের পড়াতে পারেননা। পথের পাঁচালির আপু-ভাইয়াদের কাছে পড়ে আমি বিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বার প্রথম ,দ্বিতীয়ও হয়েছি। তাই পথের পাঁচালিকে আমার মাও অনেক পছন্দ করেন। স্কুলের পড়া না বুঝলে আপু-ভাইয়াদের কাছে বুঝে নিই। এখানে আমাদেরকে নিজের ভাই-বোনের মতো করে পড়ান ওনারা। তাদের যতেœ আমরা এতটুকু এসেছি। তাদের সহযোগিতা নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চাই।’

কেবল পাঠদান নয় শিশুদের শিক্ষা সামগ্রী,পরিচ্ছন্নতা সামগ্রীও বিতরণ করে থাকে সংগঠনটি। সেই সঙ্গে জাতীয় সকল দিবসে পুষ্পস্তবক অর্পণ পরবর্তী আয়োজন করা হয় খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পবিত্র রমজান মাসে শিশুদের পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হয় রমজান ও সেহেরী সামগ্রী। ‘পথের পাঁচালি’র মাধ্যমে পবিত্র ঈদুল ফিতরে শিশুরা পায় নতুন জামার আনন্দ। প্রতিমাসে অভিভাবক সমাবেশ ডেকে অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময় করেন সংগঠনের শিক্ষার্থীরা। সমাবেশে প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দেখানো হয় শিক্ষা ও সচেতনতা মূলক বিভিন্ন ভিডিও।

সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক আফরিনা কাউসার সুজানা বলেন,‘শিশুরা তাদের যেকোনো সমস্যা আমাদের জানাতে পারে। আমরা তাদের ছোট বড়ো সকল সমস্যা সাধ্যমতো সমাধানের চেষ্টা করি। আমাদের উদ্দেশ্য তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। আমরা আনন্দিত যে ৭ টি বছর ইতোমধ্যে অতিক্রম করে ফেলেছি। মাঝে করোনার মতো মহামারির সময়টা গেছে ,তবে তাদের হাত ছাড়িনি। সবাই মিলে চাঁদা যোগাড় করে ক্যাম্পাস বন্ধের সেই সময়টাও তাদের পাশে ছিলাম। আমরা এই প্রচেষ্টায় দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে চাই।’