সাবেক নাকি প্রেরণা

বাসিংথুয়াই মার্মা

ভেবেছিলাম তার সাথে আর দেখা করবো না। আর কথা বলবো না। যোগাযোগও রাখবো না আর। এ ভাবনাটা যে আমার কাল হয়ে দাঁড়াবে আমি বুঝতে পারিনি। তরুণমন সেই কখন থেকে নীল আকাশের কাছে কিভাবে যে হারিয়ে গিয়েছিল, তরুণ কি বুঝেছিল?

কতদিন কত ভাবেই চেষ্টা করেছি মনে করবার। সবকিছু  তেমন আর মনে নেই। তবে এত টুকু মনে আছে, আমার প্রাণচঞ্চল মনটি পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তখনো আমাদের মোবাইল সংযোগ তেমন ছিল না। মিনিটে ৩/৪ টাকা হারে দোকানের মোবাইল ব্যবসায়ীর দয়ার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল আমাদের দেখা হওয়া, কথা হওয়া।

দিন যায়, মাস যায়। খুব সম্ভব তিন মাস কিংবা সে রকম হবে, আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। কেনই বা দেখা হতে হবে? আমাদের একে-অপরের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট  তো নাই। নাই কোনো প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা।

কেমন জানি মনটা দিনকে দিন উদাসীনতায় ভেসে বেড়াচ্ছিল।   ক্লাসে যাচ্ছি। শাটল ট্রেনে চড়ছি। ঝুপড়িতে আড্ডা দিচ্ছি। বন্ধুদের সাথে আদিরসের চুটকি, রসময় গুপ্ত আলাপ করছি।  খুশবন্ত সিং-এর দিল্লি, ট্রেন টু পাকিস্তান,  বুদ্ধদেব গুহ’র সুখের কাছে, মাধুকরী, সমরেশ মজুমদারের কালবেলা, কালপুরুষ, উত্তরাধিকার, সুনীলের পূর্ব-পশ্চিম, ছবির দেশে কবিতার দেশে কিংবা আন্তর্জাতিক আইন, রোমান আইন, সাংবিধানিক আইন কোনোটাতেই আর মন বসাতে পারিনি।

ক্যাম্পাস থেকে ফেরার শাটল ট্রেনে নিজের শেষ স্টেশন বটতলী না পৌঁছার আগেই কতবার অজান্তে ষোলশহর স্টেশনে নেমে শপিং কমপ্লেক্স কিংবা আড়ং-এ গিয়ে তাকে খুঁজেছি। হুঁশ হওয়ার পর বুঝেছি, তার তো আমার জন্য কোথাও অপেক্ষা করার কথা ছিল না! আমি পাগলের মতো কাকে খুঁজছি তবে! সে কি আদৌ আমাকে নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা করে? হুঁশ হওয়ার পর হেঁটে গিয়েছি ষোলশহর থেকে নিজ হোস্টেল পর্যন্ত।এভাবেই কেটে যাচ্ছিল নিয়মিতভাবে অজান্তের অনিয়মিত সময়গুলো।

গ্রামীণফোন বিশেষ সুবিধা নিয়ে ডিজুজজোড়া সিম চালু করলো। ক্যাম্পাসে অনেক বন্ধুর ডিজুজ নিয়ে অনেক আলাপ। খুব সম্ভব ১ বৈশাখের দুদিন আগে হঠাৎ ফোন এলো তার থেকে। আমি যেন তার সাথে দেখা করি …। তার থেকে দেখা করার আহ্বান কিংবা ফোন আমার জন্য চাতক পাখির মুখে বৃষ্টির পানির ফোঁটা পড়ার মতো ছিল।

আমার আনন্দ কে দেখে! সেই বিখ্যাত দু-পকেটওলা গাবার্ডিন শার্ট, জিন্স পেন্ট, সেন্ডেল পরে সন্ধ্যায় তার সামনে হাজির হলাম।

আমাকে দেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, আমি কেমন আছি। মনে মনে বললাম, একটা মানুষ বারান্দায় ঘুমানোর পর, চুরি করে কিছু দেখতে চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর যে রকম থাকে। মুখে বললাম, ভালো আছি। কত প্রশ্ন, কত জিজ্ঞাসা। কেন এতদিন দেখা করিনি। তার মুখের কথা যেন শেষ হতে চায় না। তার সাথে এতদিন কেন দেখা করিনি? কেন যোগাযোগ রাখিনি? আমি যেন বসনিয়ার কোনো যুদ্ধাপরাধী।

মনে হচ্ছে যেন যোগাযোগ না রাখার অপরাধে কোনো আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে তুলে আমাকে বিচার করে ছাড়বে। সে বলল,  চলো, নেভালে যাই। আমি বললাম, কি দরকার অতদূর!  তার চেয়ে চলো রিকশা করে ঘুরি। ঘণ্টায় ৩০ টাকা। রিকশায় উঠেছি দুজন। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী পাইলট। জিজ্ঞেস করলো, মামা কই যাইবেন?

আমি বললাম, আপনার যেখানে ইচ্ছে সেখানে নিয়ে চলেন।

রিকশাওলা বললো, কই যাইবেন ঠিক না করে, দামদর ঠিক না করে উইঠা পড়লেন? আমি বললাম, আপনার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই নিয়ে চলেন, দুঘণ্টা ঘুরবো।

বেরসিক পাইলটের ছেঁড়া গেঞ্জি। তার দিয়ে জোড়া লাগানো সেন্ডেল। পরনে ডোরাকাটা লুঙ্গি। আমাদের দুজনের নীরবতা পাইলটের সহ্য হলো না। নীরবতা ভেঙে পাইলট হঠাৎ বলে বসলো, কি মামা, কই যাইবেন, সেটাও কইলেন না। আফনারা দুজন চুপচাপ বসে আছেন। আফনাদের কোনো ঝামেলা চলতেছে নাকি? আমি বললাম, তুমি কোনো বৈদ্যগিরি করো নাকি? পাইলট বলল, না।

পাইলট শরীরের সকল শক্তি প্রয়োগ করে প্যাডেল ঘোরাতে- ঘোরাতে মেট্রোপলিটন শহর ঘুরতে থাকে। আমরা দুজন রিকশায় পাশাপাশি বসে ভাবতে থাকিÑ কি বিষয় নিয়ে কথা শুরু করা যায়।

সময় গড়াতে থাকে। বিকাল থেকে সূর্যাস্ত, সূর্যাস্ত থেকে  গোধূলি। দুজনের মনের ভিতর মন, হৃদয়ের ভিতর রক্তক্ষরণ। কত প্রকার ঘূর্ণিঝড়, কত সাইক্লোন বয়ে যেতে থাকে।

অনেকক্ষণ পর সে জিজ্ঞেস করলো, সেদিন আমার বাসায় থাকার পর তোমার আর কোন হদিস নাই। ব্যাপার কী? বারান্দায় রেখেছি বলে রাগ করেছ?

আমি কি জবাব দেবো, বুঝতে পারছি না।

শুধু এতটুকুই বলেছি, তোমার বারান্দাটা পরিপূর্ণ, পরিপাটি ছিল ।

আমার হোস্টেলের ব্যাচেলর রুমের বিছানার চেয়ে হাজার গুণে আরামদায়ক ছিল।

সে হাত বের করে দেখালো। হাতের কনুই থেকে কব্জি অবধি বিভিন্ন রঙের চুড়ি। বলল, দুদিন পর পহেলা বৈশাখ। আমাদের বৈসাবি। সে এ বৈসাবিতে নিজ গ্রামের বাড়ি যাবে না। মা-বাবা থেকে অনুমতি নিয়েছে। বৈসাবি’র পর তারপরের মাসের পূর্ণিমাতে তথা বুদ্ধপূর্ণিমায় গ্রামের বাড়ি যাবে।

আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি গ্রামের বাড়ি যাবো কিনা? আমি বললাম, আমার কোন ঘরবাড়ি আছে নাকি? ছোটোবেলা থেকে মামা-চাচা, মিশন হোস্টেলে থেকে বড় হয়েছি।

যখন যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছি, সেখান থেকে সনদ না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের কোথাও যাওয়ার কোনো পথ নাই। যাওয়ার ঘরও নাই।

আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, চলো, আমাদের বাড়িতে। বুদ্ধপূর্ণিমা তিথিতে আমাদের গ্রামের বাড়িতে অনেক বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। ছুটি নিয়ে অনেক বন্ধু গ্রামের বাড়ি আসবে। গ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকবে। তোমার ভালো লাগবে। তুমি ছোটোবেলা থেকে পরিবার পাওনি, পারিবারিক আনন্দ পাওনি, চলো তোমাকে নিয়ে যাবো দ্বিতীয়বারের মতো আমাদের গ্রামে, আমাদের বাড়িতে।

মা ও বাবাকে নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ নাই। বলে, বাড়ির সব কাজ মা একাই করে থাকেন। বাবা উদাসীন টাইপের। তবে খুব ভালো।  মা-বাবার মধ্যে গভীর প্রেম। একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারে না। চলো, তোমাকে আমাদের বাড়িতে আবার নিয়ে যাবো। রুপালি নদীতে তোমাকে সাঁতার শেখাবো। বন্ধুদের নিয়ে বনে ঘুরতে যাবো। তোমার ভালো লাগবে। ছোটোবেলা থেকে হোস্টেলে বড় হয়েছ। চলো, এবার আমার পরিবারের সাথে পরিচয় করে দিই। মা-বাবা, ভাইবোনদের সাথে আনন্দটাই আলাদা। তার লোভনীয় আহ্বান, সরলমনের প্রস্তাব আমার মন ও হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করে দিচ্ছিল। আমি তার এ প্রস্তাবে হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই বলতে পারেনি।

বলল, যদি কোথাও না যাও, তাহলে পহেলা বৈশাখের দিনে  ডিসিহিল পার্কে সারাদিন থাকবো, পান্তা-ইলিশ খাবো। সারাদিন ঘুরবো। আমাকে ভোর সকালে এসে নিয়ে যেও। আমি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়ে শুধু চুপ করে থেকেছি।

দুঘণ্টা রিকশায় ঘুরে তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে বীরের মতো একই রিকশা নিয়ে তার সামনে থেকে একটু দূরে গিয়ে পাইলটকে ছেড়ে চলে আসলাম হোস্টেলে।

দুদিন পর পহেলা বৈশাখ।

ভোর নয়, সকাল ৭/৮ টার দিকে হবে, তাঁর বাসার সামনে গিয়েছি তাকে নিতে। হালকা অভিমান, হালকা রাগ। কেন আমি দেরি করলাম! রাগ-অভিমান কোনোটাই কি সেও প্রকাশ্যে দেখাতে পারবে? আমরা তো আমাদের নই, আমরা আমাদের ছিলাম না। আমরা ছিলাম আমাদের গহিন অন্তরের।

পহেলা বৈশাখে ডিসিহিল পার্ক, লালদিঘির পাড়Ñ কত্ত জায়গায় ঘুরেছি। লোকারণ্যে তার হাত ধরে হেঁটেছি। তার নিরাপত্তার অজুহাতে তার স্পর্শে আমার মনে চরম আন্দোলন অনুভব করেছি। সেও নিজেকে অধিকতর নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আমাকে,  আমার হাতকে, এমনকি আমার কনুইতে ধরেছিল। আমরা উভয়ই নিরবচ্ছিন্নভাবে নিরাপত্তা ও উষ্ণতা অনুভব করেছিলাম।

সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকাল, বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দুজন পহেলা বৈশাখ নববর্ষের পার্বণে কাটিয়েছি। সন্ধ্যাবেলায় তাকে পৌঁছাতে গেলাম। রিকশা থেকে নামার পর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ছোটো পেকেট বের করে দিয়ে বলল, আমি জোড়া ডিজুজ সিম কিনেছি। একটি আমার, অপরটি তোমার।

আমি বোকার মতো চেয়ে আছি তার দিকে। আমার মোবাইল নাই। ডিজুজ সিম দিয়ে কি করবো! সে বলল, সব বুঝি। তোমার যেদিন মোবাইল হবে সেদিন থেকে আমরা জোড়া ডিজুজে মোবাইলে কথা বলবো। রেখে দিও। আজ নাই তো কি হয়েছে? কাল হবে।

সত্যি আমার সব হয়েছে। মোবাইল হয়েছে। তার দেয়া ডিজুজটাও আছে। শুধু সে আমার নয়। আমি তার হতে পারিনি।

আমরা পারিনি আমাদের সত্যিকার নববর্ষকে আমাদের আঙিনায় আমন্ত্রণ জানাতে। আমাদের দুজনের অজান্তে ও অকারণে কেমন জানি বিনাসুতোতে বেঁধে গিয়েছিল তরুণ্যছোঁয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও মেট্রোপলিটন জীবনটি। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি, কখনো কুয়াশাচ্ছন্ন তা। তবে কোনটাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি তার সাথে দেখা হওয়ার কোনো মহেন্দ্রক্ষণ!

শুধু ব্যর্থ হয়েছি ধুলোমাখা অন্তরের গহিনের, মনের আঙিনার ঘরকে আলোকিত করতে। এভাবে কেটে গেছে আরও কত সময়, আরও কত কিছু। মেট্রোপলিটন শহরে আমাদের অপ্রকাশিত প্রেম।