ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে আসছেন না কেন

সুভাষ দে »

জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১১.৫১ শতাংশ আর চট্টগ্রামÑ১০ আসনে ভোট পড়েছে ১১.৭১ শতাংশ। এর আগে চট্টগ্রাম-৮ আসনে ভোট পড়েছে ১৪.৫৫ শতাংশ। নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়ার কথা বলেছে। যদিও ঢাকা-১৭ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার বিষয়টি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে দেশে বিদেশে নানা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সাধারণ নির্বাচনের আর ৫ মাস বাকি এ সময় উপনির্বাচনে মানুষের আগ্রহ কম থাকবে এটি অস্বাভাবিক নয়। তবে এটি পরিষ্কার হয়েছে যে, নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে, প্রধান প্রধান বিরোধীদল সহ অন্যান্য ছোট বড় দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে জনগণের মধ্যে ভোট নিয়ে উৎসাহের সঞ্চার হয় না। তবে যেটি আশ্চর্য ঠেকেছে সেটি হচ্ছে, এই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের জনসমর্থনের বিষয়টি টের পাওয়া যায়নি যদিও অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সাফল্য দেশে বিদেশে প্রশংসা পেয়েছে, এই প্রশংসার ফসল ঘরে তুলতে সরকারি দলের জনসম্পৃক্ততা অর্জন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটা হয়নি; সরকারি দল সরকারের কাজকর্মের যথাচিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। অন্যদিকে দলের কিছু নেতাকর্মী সংগঠকদের নানা অপকর্ম মানুষের বিরক্তির কারণ হয়েছে। তাছাড়া, সমাজে অপরাধ প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, অপরাধীরা প্রভাবশালীদের মদদ পেয়ে বেপরোয়া হয়েছে অপরাধের যথাযথ শাস্তি না হওয়া এবং প্রতিকারের পথ অনির্দেশ্য থাকায় মানুষ হতাশ হয়েছে।
অবশ্য স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নানা নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে এসেছে। এক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা বেশি ছিল। সদ্যসমাপ্ত সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনে স্থানীয় কাউন্সিলরদের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রচারÑপ্রচারণার কারণে ভোটাররা আকৃষ্ট হয়েছেন। তবুও ভোটার উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এ যাবৎ অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হয়েছে। অতীতে নির্বাচন কমিশনগুলো আইন প্রয়োগে কঠোর না হওয়ায় নির্বাচনে হানাহানি, সহিংসতা বেড়েছে, এমন কি এসব নির্বাচনের ফলাফলের জেরে পারিবারিক সামাজিক শত্রুতা বেড়েছে। সমাজের সম্প্রীতি ও সুস্থিরতা বিনষ্ট হয়েছে।
এক সময় এমন কি দুই তিন দশক আগেও জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন উপলক্ষে গ্রামেÑশহরে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করতো। দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি, পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে নানা কায়দায় মানুষের কাছে ভোট প্রার্থনা করতেন। ভোটের নানা রঙ্গব্যঙ্গ মানুষের কাছে উপভোগ্য ছিলো। চায়ের দোকানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজনীতি, প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে তর্কবিতর্ক, আড্ডা এসব অনুষঙ্গ নির্বাচন ও নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থার প্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হতো। ভোটের দিন নারীÑপুরুষ বৃদ্ধ ভোটারদের দীর্ঘলাইন, স্বেচ্ছাসেবক ও প্রার্থীর কর্মীদের হাঁক ডাক ছাড়া অন্যকিছু শোনা যেতোনা।
সেই সব দিন বাসি হয়েছে, এখন প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি যান না, কর্মীদের নিয়ে রাস্তায়, অলিগলিতে শোÑডাউন করেন। প্রচারÑপ্রচারণায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। কর্মী সমর্থক ও ভোটারদের বাগে আনতে অর্থ ছড়ান। দলে ভেড়াতে শক্তি দেখানো হয়Ñ এটি চলে দীর্ঘসময় পর্যন্ত। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কঠোর হলে এই পরিস্থিতি সহজে দমন করা যেতো কিন্তু তা হয়নি। আবার স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রভৃতি পদে দলীয়ভাবে মনোনয়ন চালু হওয়ায় দলাদলি, হিংসাÑবিদ্বেষ বেড়েছে। পরিবারে পরিবারে শত্রুতা বেড়েছে, সমাজের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়েছে, এই সুযোগে ধর্মীয় বিদ্বেষ জায়গা করে নিয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থার একটি ক্ষতিকর দিক হচ্ছে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অভিলাষ। এ জন্য প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে হুমকি-ধামকি, দলীয় প্রতিপত্তির চাপ, অর্থ দিয়ে বশীভূত করাÑএসব নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নিকট অতীতে স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনে পূর্বাপর সহিংসতা দেখা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সমর্থকের বাড়িঘরে হামলা লুঠতরাজ ও খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। তাতে মানুষ একদিকে যেমন নিরাপত্তাহীনতার কারণে অসহায়বোধ করেছে, অন্যদিকে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাব ও প্রকট হতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালে নির্বাচনের পূর্বাপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, লুঠতরাজ, নারী ধর্ষণের মতো নারকীয় ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়।
দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রধান বিরোধীদল বিএনপি জাতীয় সংসদ কিংবা স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় এবং ক্রমাগত ভোট বর্জন করায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুপস্থিতি প্রকাশ পেয়েছে। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপুল সংখ্যক প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার মতো বিষয়গুলো নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তদুপরি নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব, পেশি শক্তির প্রদর্শন, অতিরিক্ত নির্বাচনী ব্যয়, দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের, পারিবারিক গোষ্ঠীগত ব্যক্তিদের প্রার্থী মনোনয়ন ভোটারদের হতাশ করেছে।
কেন ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে আসছেন না তার উত্তর খুঁজতে হবে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সরকারি প্রশাসন ও সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দল ও দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে। নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা দেশের গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে না কেবল, বিদেশিদের কাছে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়ে। যেহেতু তারা আমাদের উন্নয়নের অংশীদার, অর্থনীতি ও ব্যবসাবাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত সুতরাং তাদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আমাদের বিবেচনায় নিতেই হবে। বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক সচেতন মহল বলছেন, নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য, সেই সাথে প্রার্থী বাছাইয়ে সৎ যোগ্য ও মেধাবী এবং জনগণের সুখেÑদুঃখে পাশে থাকে যারা তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ভোটারদের কাছে প্রার্থী উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য না হলে তারা ভোট কেন্দ্রে আসতে উৎসাহী হবেন না। রাজনীতিবিদ এবং প্রার্থীরা ভোটের আগে নানারকম প্রতিশ্রুতি দেন কিন্তু নির্বাচিত হলে তাদের দেখা মেলে না। জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি তারা বিস্মৃত হন। নিজের উন্নতি ও অর্থনৈতিক সুবিধায় ব্যস্ত থাকেন। ভোটের পূর্বাপর সহিংসতাও মানুষকে রাজনীতি বিমুখ, ভোট বিমুখ করে তোলে।
নির্বাচনে সৎ, যোগ্য ও শিক্ষিত লোকদের মনোনয়ন দিতে হবে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রথা তুলে দেয়ার কথা বিবেচনা করতে হবে। নতুবা ভোটাররা আশ্বস্ত হবেন না। নির্বাচনী ব্যয় কমাতে হবে যাতে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পেশাজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য মানুষকে হতাশ করে এটি চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে। সকল রাজনৈতিক দল যদি ভোটে আসে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটযুদ্ধের আভাস মিললে জনগণের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার হবে। ভোটের পূর্বাপর নিরাপদ, সহিষ্ণু ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ ভোটারদের আস্থা বাড়াবে। এ ক্ষেত্রে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে কেউ কোন পর্যায়ে নির্বাচিত হতে না পারেন সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক হতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তন না হলে নির্বাচনে ভোটার খরা চলতেই থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক