ভেজাল সয়াবিনে বাজার সয়লাব

বিএসটিআই’র অনুমোদন ছাড়া বিক্রি হচ্ছে পরিত্যক্ত বোতলে

Pouring food oil in hot pan for deep frying.

রাজিব শর্মা »

নগরীর পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেলের নামে পাম ও সুপার পাম তেল। বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে নাম সর্বস্ব বিভিন্ন কোম্পানি। বিএসটিআই ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই তারা এসব তেল বাজারজাত করছে।

অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খোলা পাম ও সুপার পাম সংগ্রহ করে ময়লাযুক্ত বড় প্লাস্টিকের ড্রামে সংরক্ষণ করে এবং পরে সেখান থেকে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতলে তেল সংগ্রহ করে বোতলের গায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টিকার লাগিয়ে ‘সয়াবিন তেল’ নামে বিক্রি করছে।
এছাড়া, ভেজাল তেল বাজারজাত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এড়াতে নগরী ও তার পাশ্ববর্তী উপজেলার গ্রামীণ এলাকাগুলোকে টার্গেট করছে এসব ব্যবসায়ী। নিম্নমানের এসব খোলা ‘সয়াবিন তেল’ বাজারে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সাধারণ ক্রেতারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। এতে প্রতিনিয়তই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে মানুষ।

সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম বাজার নগরীর খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, বাকলিয়ার রাজাখালী রোড, কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ, কর্ণফুলী দক্ষিণ পাড়, মইজ্জারটেক, ইপিজেডের বিভিন্ন এলাকা, পতেঙ্গার ১২ নম্বর ও ১৫ নম্বর ঘাট এলাকা ভাসমান কয়েকটি তেলের দোকানসহ নগরীর প্রায় অর্ধ শতাধিকের ওপর এলাকায় খোলা বাজারে সয়াবিন তেলের নামে পাম ও পাম সুপার তেল বোতলজাত করে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিত্যক্ত নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের বোতল। এসব বোতল সংগ্রহ করা হয় স্থানীয় ভাঙ্গারি বা স্ক্র্যাপের দোকান থেকে।
সয়াবিন তেলের পাশাপাশি তারা একইভাবে বোতলজাত করছে সরিষা ও নারকেল তেলও। এসব তেল বিক্রেতাদের কাছে কোন ধরনের বিএসটিআই-র অনুমোদন নেই।

অভিযানের পরও বেপরোয়া এসব ব্যবসায়ী
ভেজাল সয়াবিন ঠেকাতে জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার, বিএসটিআই ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালিত হওয়ার পরও কোনভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না এসব অসাধু ব্যবসায়িক কর্মকা-।

১২ সেপ্টেম্বর নগরীর কর্ণফুলীর কালারপোল স্কুলের পাশের ভেজাল সয়াবিন তেলের কারখানার সন্ধান পায় র‌্যাব। এ কারখানা থেকে অননুমোদিত বিভিন্ন ব্রান্ডের লোগো ব্যবহার করে বাজারজাত করার সময় মূলহোতা আলমগীর, তার দুইজন সহযোগী সাইফুল আলম হৃদয় ও মো. শাকিল নামের তিনজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ অভিযানে উদ্ধার হয়েছিল প্রায় ২ হাজার ৬৬১ লিটার ভেজাল সয়াবিন তেল। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৫ লাখ টাকা।

র‌্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক নূরুল আবছার বলেন, ঐ কারখানায় অভিযানের পর তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় তারা বিভিন্ন খোলা বাজার থেকে খোলা তেল সংগ্রহ করে, প্লাস্টিকের বোতলে নামে বেনামে বিভিন্ন কোম্পানির স্টিকার ও বিএসটিআই লোগো ব্যবহার করে বাজারজাতকরণের কথা স্বীকার করে।

জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরও বলেন, বাইরের খোলা বাজার থেকে পাম ও পাম সুপার সয়াবিন তেল সংগ্রহ করে উক্ত সয়াবিন তেলে ভেজাল অস্বাস্থ্যকর উপাদান মিশিয়ে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ১৮৫ লিটারের বড় ড্রামে সংরক্ষণ করত। ঐ বড় ড্রাম থেকে ৫, ২, ১ লিটার, ৯০০ এমএল ও ৫০০ এমএল প্লাস্টিকের বোতলে ঢেলে বোতলের গায়ে বিএসটিআই এর অনুমোদন ব্যতীত লোগো যুক্ত ‘আয়ান ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল’ ও ‘এস. জালাল সয়াবিন তেল’ নামে মোড়ক সংযুক্ত করে দীর্ঘদিন ধরে বিক্রি করে আসছেন।

খাদ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যার্ন্ডাডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউটিশন (বিএসটিআই) এর অনুমোদন লাগে। কিন্তু এসব খোলা সয়াবিনের বাজারজাত তেলের বিএসটিআই এর কোন অনুমোদন নেই। অথচ বিএসটিআইএর লোগো এবং নাম্বার ব্যবহার করে তেলের বোতলে স্টিকার লাগানো হয়েছে। বাজারে পরিচিত কোম্পানিগুলোর নামের খুব কাছাকাছি নাম এবং লোগোর মতো করেই স্টিকার তৈরি করা হয়েছে। সাধারণ ক্রেতারা এসব স্টিকার দেখে সহজেই প্রতারিত হচ্ছেন। বোতলে তেলের পরিমাপও ঠিক নেই। এক লিটার ওজনের তেলের বোতলে অন্তত ২০০ গ্রাম তেল কম দেয়া হয়। সরেজমিনে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে এর সত্যতা মিলেছে।

বিএসটিআই উপপরিচালক মাজহারুল হক বলেন, ‘খোলা বাজারে ড্রামে করে তেল বিক্রি বন্ধ করতে অনেকবার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া নগরীর বিভিন্নস্থানে যেসব ড্রামে করে খোলা তেল বিক্রি করছে তাদেরকে নোটিশেও জানানো হয়েছে। আমরাও বাজার তদারকিতে আছি। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘ড্রামে সংরক্ষণ করে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতলে সয়াবিন বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে বাজারে তা এখনো চলমান রয়েছে কি’না বিষয়টি আমাদের নজরদারিতে এখনো আসেনি। তবে এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার তৎপর রয়েছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি’।

উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (এফএও) গ্লোবাল ফোরাম ফর নিউট্রিশনের তথ্যানুযায়ী, সাধারণত মানবদেহে অন্তত ৩০ শতাংশ ক্যালরি ভোজ্য তেল থেকে আসা দরকার। অথচ দেশীয় পর্যায়ে মাত্র ৯ শতাংশ ভোজ্যতেল থেকে আসছে। মানবদেহের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান ফ্যাটি এসিডের প্রধান উৎস ভোজ্য তেল। কিন্তু অতিমাত্রায় ভেজালের কারণে কাক্সিক্ষত মাত্রায় মিলছে না এসব প্রয়োজনীয় উপাদান। উল্টো বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় প্রধান (ল্যাব) ডা. মো. জয়নাল আবেদীন টিটু বলেন, ‘সরকার বলেছে পলিব্যাগে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ সয়াবিন বিক্রি নিশ্চিত করতে। খোলা বাজারে সয়াবিন বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এখন খোলা বাজারে সয়াবিনের নামে যেসব তেল বিক্রি করছে, তাতে যদি অনান্য তেল বা রাসায়নিক উপাদান মিশ্রণ করে একজন ভোক্তার পক্ষে তা বুঝা কখনোই সম্ভব না। সুতরাং এসব বিষয়ে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সয়াবিন তেল ক্যালরি হিসেবে এবং অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এটি এমন খাদ্য উপাদান যা শুধু পুষ্টির দিকে অনন্য নয়, অনেক ভয়ানক রোগ প্রতিরোধে এর রয়েছে অসীম ক্ষমতা। কিন্তু খোলা বাজারে যেসব সয়াবিন তেলের নামে ভেজাল তেল বিক্রি করছে এতে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও কোলেরেস্টরল বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে।’