বীজধান

মইনুল আবেদীন

‘আঁই তোঁয়ারে ইবা ন দিয়ম’ … গত বছর মেলায় কেনা বাঁশিটা আয়েশার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আকবর হোসেন খুব জোরে দৌড় মারে। পেছন-পেছন কাঁদতে-কাঁদতে আয়েশাও দৌড়ায়। কিন্তু আকবর হোসেন খুব বেশিক্ষণ দৌড়ে পারে না। তার নাকি হৃৎপি-ে খুব বড় রকমের সমস্যা আছে, ডাক্তার বলেছে। অপারেশান না করলে ভালো হবে না।
সাদ্দাম হোসেন ছোট আয়নাটা হাতে নিয়ে ঘরের পৈঠায় বসে যতেœর সাথে চুল আঁচড়াচ্ছিল। আকবরকে ধপাস পড়ে যেতে দেখে হাহা করে ওঠে গিয়ে কোলে তুলে নেয়। ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েও পারে না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসায় কেমন একটা গোঁ-গোঁ শব্দ করতে থাকে।
বড় মায়া লাগে সাদ্দাম হোসেনের। অনেক সখ করে নাম রেখেছে বাদশা আকবরের নামে। মনে সাধ ছেলে বাদশাহর মতো নামীদামি কেউ হবে। ছেলেকে অনেক লেখাপড়া শেখাবে, বড় বড় পাশ দেওয়াবে। তার আব্বা যেমন তার নাম রেখেছিল সাদ্দাম হোসেনের নামে। কেননা তার জন্মের বছর ইরাক-আমেরিকার যুদ্ধ লাগে, গ্রামসুদ্ধ লোক সাদ্দাম হোসেনের পক্ষে। সবাই সাদ্দাম বলতে অজ্ঞান। কিন্তু সে আর কীইবা হতে পারল? আড়ালে-আবডালে সবাই তাকে মেট্রিক ফেল বলে ডাকে। ছেলেমেয়ে দুটোকেই জজ-ব্যারিস্টার বানিয়ে এসবের দাঁতভাঙা জবাব দেবে ও।
আকবর হোসেনের অসুখের কথা ভেবে মাঝেমাঝে তার খুব মন খারাপ হয়। অনেক টাকার দরকার। ভাগে জমিজিরাত যা পেয়েছে নেহায়েত কম না। প্রতিবছর ধানের ফলনও হয় অনেক। তাও এসবের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে চাচাতো ভাইদের সাথে ঝগড়াঝাটি নিত্য লেগেই থাকে। এই ধানবিক্রির টাকা গত ক’বছরে বেশ কিছু জমেছে। আর কিছু জমলেই আকবর হোসেনের অপারেশানটা দ্রুত সেরে ফেলতে হবে।

শাহজাদী ঘরের ভেতর থেকে গত এক বছর বড় মমতায় আগলে রাখা বীজধানগুলো ঝাড়াই-বাছাই করতে-করতে তাড়া দেয়, ‘তোঁয়ারা আর খতো দেরী গরিবা ওয়া?’
ঠিকই তো আজ বৈশাখের প্রথম দিন, শুভদিন, আজ তো দেরি করা যায় না। সাদ্দামও আকবর আর আয়েশাকে তাড়া দেয়। আকবর কান্না ভুলে একটি টকটকে লালজামা পরে তৈরি হয়। আয়েশাও পরে লাল-সাদা ফ্রক। শাহজাদী ক্ষীরের পায়েশ রাঁধতে বসে যায়। সাদ্দাম হোসেন একটি নতুন পাঞ্জাবি গায়ে বীজধানের থলে হাতে খেতের দিকে রওনা দেয়।
খেতের কাছে এসে সাদ্দাম দেখে তার চাচাতো ভাই মুনার বাঁধা কামলা কেউন্না জমির আলে বসে কি যেন করছে। নিজের সব জমির মধ্যে এইটাই তার সবচেয়ে প্রিয়। এ জমিতে ধান নয় যেন সোনা ফলে। আর মুনার যত লোভ কিনা এই জমিটারই ওপর। এটা নাকি সে ভাগে পায়।
কেউন্নাকে জমির আলে ওভাবে বসে থাকতে দেখে সাদ্দামের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সে হাঁক দেয়, ‘কিরে ওডা কেউন্না, এডে খি রদ্দে?’
কেউন্না চমকে ওঠে, ‘আঁরে মুনা বদ্দা ফাটাইয়ে দে, পাহারা দিদ্দে।’
কার জমি কে পাহারা দেয়? রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সাদ্দাম হোসেন আলের পাশে পড়ে থাকা একটি মোটা বাঁশ তুলে নিয়ে কেউন্নার মাথা বরাবর এক ঘা বসিয়ে দেয়।
রোগাপটকা কেউন্না ‘ও মারে, মা রে’ বলে মাথা চেপে ধরে দৌড় দেয়।
কিছুক্ষণ ঠায় বসে থেকে রাগ কমে আসলে সাদ্দাম সবাইকে নিয়ে জমিতে বীজধানগুলো ছিটোতে শুরু করে। আকবর আর আয়েশা খুব মজা পায়।
ছেলেমেয়ে ঘুমিয়ে গেলে অনেক রাতে বৈশাখী চাঁদের আলোয় শাহজাদীকে খুঁটিয়ে দেখে সাদ্দাম। চাষির বৌয়ের নাম শাহজাদী? প্রথম-প্রথম তার হাসি পেত। কিন্তু শাহজাদী আসলে শাহজাদীর মতোই সুন্দর। নতুন ধানের মতো ঝরঝরা সোনালি গায়ের রং। ধানের গোছার মতো ভরাট, কোমল শরীর। সাদ্দাম পাশে শুয়ে থাকা শাহজাদীর কানে আঙুলের আলতো পরশ বুলিয়ে সুড়সুড়ি দেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব আস্তে শিস বাজায়, তারপর লতিতে কুট করে কামড় বসায়। শাহজাদী ঘুমের ভান ধরেছিল। এখন মিষ্টি হেসে সাড়া দিল।
ভোর রাতে হঠাৎ কড়া হুইসেলের শব্দে ওদের ঘুম ভেঙে যায়। তারপর দরজায় অনেকগুলো ধাক্কা। পুলিশ এসেছে। কেউন্নার মাথা ফাটনোর জন্যে মুনা থানায় মামলা করেছে। সাদ্দামকে থানায় যেতে হবে।
শাহজাদী ডুকরে কেঁদে ওঠে। আকবর আর আয়েশা তখনো অকাতরে ঘুমুচ্ছে। এত কিছুর পরেও সাদ্দামের মনে এক আশ্চর্য প্রশান্তি। যাই হোক নতুন বছরের প্রথম দিনটিতেই সে জায়গা মতো বীজগুলো ছড়াতে পেরেছে।