বাঁশখালীতে ৭ বছরে ১৫ বন্যহাতির মৃত্যু

উজ্জ্বল বিশ্বাস, বাঁশখালী »
বাঁশখালীতে ৭ বছরে ১৫ বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে। এক শ্রেণির লোক বন্যশূকরের মাংস খেতে এবং মাংস বিক্রি করতে শূকর ধরতে বিষযুক্ত কলার ফাঁদ পাতে পাহাড়ে, ওই ফাঁদে বিষযুক্ত কলা খেয়ে মারা যাচ্ছে হাতি। অপরদিকে অবৈধভাবে পাহাড় দখল করে করা ক্ষেত ও বসতবাড়ি বাঁচাতে বৈদ্যুতিক ফাঁদ ও গুলি মেরেও হাতি হত্যা করছে পাহাড়ে বসবাসকারী এক শ্রেণির লোক।
হাতি মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে নেই সরকারিভাবে শক্তিশালী পদক্ষেপ ও বিজ্ঞানসম্মত কার্যক্রম। ময়নাতদন্ত কর্মকর্তারা চোখ দেখা পর্যবেক্ষণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখেই প্রতিবেদন দেন। ফলে কী জন্য হাতি মারা যাচ্ছে তার প্রকৃত কারণ জানা যাচ্ছে না।
বাঁশখালী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. সমরঞ্জন বড়ুয়া বলেন, ‘হাতি জাতীয় সম্পদ। অনেক মৃত হাতির ময়নাতদন্ত করেছি। হাতির ময়নাতদন্ত আমরা শুধু চোখ দেখা পর্যবেক্ষণের ওপর দিই। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার সিনিয়র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছ থেকেও পরার্মশ নিই। তাতেই আমিও সন্তুষ্ট নই। হাতির মৃত্যু রহস্য বের করতে বনবিভাগকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। হাতি মারা যাবার পর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করার মতো যন্ত্র, সরঞ্জাম ও রাসায়নিক উপকরণ থাকতে হবে। দায়সারা পরীক্ষা হয় বলে হাতি মৃত্যুর রহস্য বের হচ্ছে না। এভাবে চললে ভবিষ্যতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হাতিশূন্য হয়ে পড়বে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাঁশখালীর ৩৭৬.৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মধ্যে ৭৯.৩৩ বর্গকিলোমিটার বনভূমি। এশিয়ার একমাত্র হাতির প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত চুনতি অভয়ারণ্য। আর এ চুনতি অভয়ারণ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা বাঁশখালীর বনভূমি। চট্ট গ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের আওতায় জলদী অভয়ারণ্য রেঞ্জ, পুঁইছড়ি অভয়ারণ্য রেঞ্জ ও কালীপুর রেঞ্জের আওতায় মোট ৮টি বনবিট অফিস রয়েছে। বনভূমি রক্ষায় রেঞ্জ অফিস ও বনবিট অফিস থাকলেও বন কর্মকর্তারা লোকবল সংকট ও নিরাপত্তার অভাবে অধিকাংশ সময় বনভূমি ছেড়ে উপজেলা শহর কিংবা জেলা শহরে বসবাস করেন। কোন বন কর্মকর্তার অফিসে নেই বনদস্যুদের দমনে আগ্নেয়াস্ত্র। ফলে বনদস্যুরা প্রতিনিয়ত বিস্তীর্ণ বনভূমির পাহাড় ও গাছ কেটে মরুভূমিতের রূপান্তর করে চলছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল নির্মাণ করা হয়েছে অন্তত ১৫ হাজার অবৈধ ঘর-বাড়ি। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে শতক প্রতি ২৫/৩০ হাজার টাকায় বিক্রয় করছে এবং ৩০০ টাকার স্টাম্পে রেজিস্ট্রারবিহীন দলিলও করে দিচ্ছে। এসব বনাঞ্চলে বিশাল বনাঞ্চল কেটে নির্মিত হয়েছে ৬টি ইটভাটা। বনবিহীন বনভূমি, ইটভাটার ধোঁয়া আর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ঘর-বাড়ির কারণে বনের জীব জন্তু পশু-পাখি খাদ্য সংকটে বনভূমি ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে কিংবা খাদ্য সংকটে মারা যাচ্ছে। বনাঞ্চলের অধিকাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বননির্ভও এক কৃষক বলেন, বাঁশখালীতে এক শ্রেণির মানুষ বন্যশূকর শিকার করে খায় এবং মাংস বিক্রি করে। তাই ওইসব শূকর নিধনকারীরা পাহাড়ে প্রতিনিয়ত কলার ভিতর বিষ দিয়ে বন্যশূকর হত্যা করে। এ বিষযুক্ত কলার ফাঁদের ওই পথ দিয়ে হাতির দল চলাচলের সময় বিষযুক্ত কলা খেয়ে হাতি মারা যাচ্ছে। হাতি মারা যাবার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অসুস্থতাজনিত কারণেই মারা যায় বলে প্রাথমিকভাবে মন্তব্য করেন। এতেই সবকিছু নীরব থেকে যায়।
বনবিভাগের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গত ৭ বছরে বাঁশখালীর বনাঞ্চলে মারা গেছে ১৫টি হাতি। অসুস্থ হয়ে পড়া ৩টি হাতিকে সুস্থ করে বনাঞ্চলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ১২ নভেম্বর বাঁশখালীর চাম্বল বনবিট অফিসের অদূরে ১টি হাতি মারা গেছে। ওই হাতির পেটের নিচে রক্তক্ষরণের দাগ থাকলেও ময়নাতদন্ত কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে অসুস্থতাজনিত কারণে মারা গেছে বলে চোখ দেখা পর্যবেক্ষণে মন্তব্য করেন।
সূত্র জানায়, গত ৭ বছরে কালীপুর রেঞ্জে মারা গেছে ৯টি বন্যহাতি। জলদী ও পুঁইছড়ি রেঞ্জে ৬টি। কালীপুর রেঞ্জের ২০৭৭.১৭ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বনের ভিতর নির্মাণ করা হয়েছে ৬টি ইটভাটা। এসব ইটভাটা অবিরত পাহাড় কেটেই ইট তৈরি হলেও বনবিভাগের পক্ষ থেকে কোন ইটভাটার মালিকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি। এমন কী তারা ওইসব ইটভাটার মালিকদের ইটভাটা করার অনুমতিও দেননি। গত ১০ বছর ধরে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতরই এসব ইটভাটায় বাধাহীন ইট তৈরি করে চলছে। ওইসব এলাকায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে সামাজিক বনায়ন করা হলেও বিস্তীর্ণ এলাকার সামাজিক বনায়নের অস্তিত্বই নেই। দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির কারণে বেশ কয়েকজন বনবিট কর্মকর্তার কার্যালয়ে ইঁদুরের বাসা তৈরি হয়ে আছে।
বনবিভাগের কালীপুর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হাতি মারা যাওয়া, পাহাড়খেকোদের পাহাড়কাটা, গাছকাটা এবং ইটভাটা তৈরির ব্যাপারে বনবিভাগ একা দায়ী নয়। জেলা প্রশাসন, আইন শৃংখলা বাহিনী এবং বনবিভাগ যৌথভাবে অভিযান ছাড়া প্রভাবশালী বনদস্যু ও পাহাড়খেকোদের দমন করা যাবে না।’ এছাড়া বন্যপ্রাণী রক্ষায় বনাঞ্চলে ফলদ বাগান সৃজন করা খুবই জরুরি। নচেৎ বনাঞ্চলে এখন যেসব প্রাণী আছে তাও থাকবে না। ব্যাপক হারে হাতি মৃত্যুর কারণ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
পাহাড় কাটা ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ইটভাটা তৈরির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষকে লিখিত কোন প্রতিবেদন দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘কর্তৃপক্ষ না চাইলে আমি নিজে থেকে তথ্য দিয়ে বিপদ ডেকে আনব কেন ?’ বনাঞ্চল ধ্বংসের কাহিনী বহুদিনের পুরনো বলে দাবি করেন ওই বন কর্মকর্তা।
জলদী ও পুঁইছড়ি অভয়ারণ্য রেঞ্জের রেঞ্জার এবং বাঁশখালী ইকোপার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, ‘বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল অনুসারে লোকবলের খুবই অভাব। বনদস্যুদের নানামুখী অত্যাচারে বন্যপ্রাণীরা খাদ্য সংকটে পড়েছে। ওইসব দাগী অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও ১০/১৫ দিনের মধ্যে জামিনে এসে আবারো বনাঞ্চল ধ্বংসে নেমে পড়ে। কঠোর হস্তে দমন করা হলে এবং আদালত জামিন মঞ্জুর না করলে বন ধ্বংসের ঘটনা কমে যেত। ফলে বন্যপ্রাণীরা নিরাপদে বনাঞ্চলে বিচরণ করতে পারত।