ফুলকি

দীপক বড়ুয়া

ভাস্কর। একজন অতি সাধারণ ছেলে। ভার্সিটিতে পড়ার সময় দেখা, পরিচয়। এটাকে মিথ্যে বলা হবে এ জন্যই, কারণ একই ক্লাসে পড়তাম আমরা। লেখাপড়ায় খুবই মেধাবী ছিল। তবে একবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক বা স্মার্টনেস বলতে যা বোঝায় ভাস্করের তা ছিল না।
পরনে থাকত পাজামা-পাঞ্জাবি। না-হয় সাধারণ শার্ট-পেন্ট। কারো সাথে তেমন কথা বলত না। অধ্যাপক আসতেন, লেকচার শুনত, তারপর চুপচাপ। শুনেছি লিখতে ভালোবাসে। পত্রিকায় ওর গল্প কবিতা ছড়া প্রকাশিত হতো। ভাস্কর ভালোই লিখতো। ওর গল্পের হাত যেমন, ছড়া-কবিতার হাতও তেমন। লেখকের স্বভাব বুঝি এমনই হয়। কম কথা বলা, চুপ থাকা।
কী অদ্ভুত ছেলে, কথা না বলে কেউ পারে! সে ক্ষেত্রে ভাস্কর ভিন্ন। সে কথা না বলে পারে। অযথা কৌতূহল মনে চেপে রাখতে না পেরে নির্লজ্জের মত ওর সঙ্গে কথা বলি। ভাস্কর করিডরে দাঁড়িয়ে, একা। কাছাকাছি হয়ে বললাম, আমি ফুলকি।
ও আমাকে দেখে কি না দেখে চুপ থাকে। ভাবি, ভারি অহংকার আছে তো! যাই থাকুক ভাঙবই। দ্বিতীয়বার ও বললাম, আমি ফুলকি। হঠাৎই মেঘের আগমন এবং বৃষ্টি। আজকালের পরিবেশটাই এমন। এই বৃষ্টি, এই হাওয়া। এই বৃষ্টির রূপটা তেমন নয়। ঝুপঝুপ পড়ছিল একটানা। দুজনেই ভিজছি বৃষ্টি ফোটাঁয়। বৃষ্টি থেকে বাঁচার কারো লক্ষণই নেই। অন্যসব ছাত্ররা ক্লাসরুমে চলে যায়।
করিডরে ভাস্কর এবং আমি। বৃষ্টি পড়ছে। মেঘ ডাকছে। ততক্ষণে আমি ভাস্কর ভিজে জবুথবু। রাটি নেই কারো মুখে। শুধু আমি বেহায়ার মতো কথা বলছি।
একসময় বৃষ্টি, মেঘের ডাক থামে। আমি আবারও বলি, তুমি তো ভিজেই গেছো! হঠাৎ আমার কানে বাজে, তুমি কি না ভিজে আছো!
এই প্রথম ভাস্করের মুখের কথা শুনলাম। দরাজ গলা, মিষ্টি। ও না থেমে বলে, তুমি ফুলকি। নামটি সুন্দর, কেমন জানি ভয় ভয়, ভয়ানক!
ও সেই এক মজার ব্যাপার। আমার জন্মে পর সাধারণ শিশুর মত কান্না ছিল না আমার। বড় স্বরে বিরতিহীন কাঁদছিলাম। বাবা বাইরে ভয়ে কাঁপছে। মা’র পাশেই আমি ছিলাম। তখনই মা আমাকে ফুলকি নামে ডাকে। তখন থেকেই ফুলকি আমি।
ফুলকির অর্থ কি জানো! ভাস্কর জিগ্যেস করে।
হ্যাঁ, খুব ভালোই জানি। নিজের নামের অর্থ না জানাটা অথর্বের মতই। ফুলকি অর্থ হল অগ্নিকণা।
কী অদ্ভুত মিল নামের সাথে চরিত্রের। ভাস্করের উত্তর।
আবারও ভাস্করের নীরবতা। ভাল্লাগেনা।
আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। কিছুদিন আগে মা মারা গেছে।
বর্তমানে বাবাই সব। বাবার একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। মাঝেমধ্যে আমাকে সাথে নিয়ে যায় অফিসে।
একদিন রাতে ভাতের টেবিলে বাবা বলে, ফুলকি, একটা কথা বলি, শোন।
বল।
তুই বড় হয়েছিস, লেখাপড়াও শেষ। আমার অবর্তমানে ব্যবসা তোকেই তো দেখতে হবে। তার আগে তোকে বিয়ে দিতে চাই। এটা আমার দায়িত্ব। তোর মা বেঁচে থাকলে কবেই বিয়ে দিতো। তুই কি বলিস। ও হ্যাঁ, আরও একটি কথা।
বলো, বাবা।
তুই ছাড়া তো আমার কেউ নেই। এই গার্মেন্টস, বাড়ি-গাড়ি সবই তোর। একজন বিশ্বস্ত জীবন সাথি প্রয়োজন তোর। সে ধরনের ছেলের সাথেই তোর বিয়ে দিতে চাই। তাতে আমি স্বস্তি-শান্তি পাবো। ওই ধরনের কারো সাথে তোর পরিচয় আছে?
তখনই মনে পড়ে ভাস্করের কথা। ও শান্ত, চঞ্চলতা নেই একটুও। ভাস্করই হবে আমার উপযুক্ত, বিশ্বাসী ও নিরাপদ সাথি। বাবাকে বললাম, বাবা আমার একজন ভার্সিটির বন্ধু আছে। নাম ভাস্কর। ওর ওপর তুমি আস্থা রাখতে পারো। আমারও পছন্দ ওকে।
বাবা তো খুশি। ঠিকানা দিলাম। একদিন বাবা যায় ভাস্করের বাসায়। ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলে দাঁড়ায় ভাস্কর।
কে? কাকে চান।
অতিসাধারণ ছেলেটি। আহামরি বেশভূষা নেই। নিশ্চয় এইই সেই ভাস্কর।
আমি ফুলকির বাবা।
আমি ভাস্কর। আপনি …
তোমার মা’র সঙ্গে দেখা করতে এলাম।
মায়ের সঙ্গে দেখা! মা তো আপনাকে চেনে না।
বারে সেকি কথা, পরিচয় নেই, হবে। বাইরে ভাস্কর ও অন্যজনের কথা শুনে মা আসে। বলে,
আপনি কে?
আমি ফুলকির বাবা। আপনার ছেলে ভাস্কর-ফুলকি একসাথে ভার্সিটিতে পড়তো।
ও তাই। আসুন, ভিতরে বসুন।
কথা বলে ভাস্করের মায়ের সাথে। ভাস্করের মা বলে,
ভাস্করের বাবা নেই। অনেক আগে মারা গেছেন। মা আরো বলে, ভাস্কর ছোট একটি চাকরি করে। ওই চাকরির আয়ে সংসার চলে।
ফুলকির মুখে শুনেছি সব। আমি এসছি মূলত আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা বলতে। আমি একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। ফুলকি ছাড়া আমার কেউ নেই। ফুলকির পছন্দ ভাস্করকে। তাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলাম। আপনি রাজি থাকলে বিয়েটা দিতে চাই ।
তা কি করে হয়, আপনি আর আমাদের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। বিয়ে কিছুতেই সম্ভব নয়।
আপনি যা ভাবছেন সেই ধরনের মানুষ আমি নই। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ।
ভাস্করকে দেখে আমিও অবাক। এই যুগে এমন ছেলে হয়? সেও আমার মত সাধারণ। বাবার পীড়াপীড়িতে রাজি হয় ভাস্করের মা। ভাস্কর বলে,
মা এটা সম্ভব নয়।
কি বললি, মুখের ওপর কথা! আমি বলছি এ বিয়ে হবে। ভাস্কর চুপ। বাবা মনে-মনে বলে, এই না হলে মায়ের ব্যাটা। শাব্বাশ ভাস্কর।
অতঃপর আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
বিয়ের পরপর বাবা মারা যান। ওদিকে ভাস্করের মাও।
বুদ্ধ বলেছেন, সংসার জীবন বড়ই দুঃখময়, যন্ত্রণাময়। তবে এতটা দুঃখের তা জানতাম না। আমি ও ভাস্কর স্বামী-স্ত্রী। একই রুমেই শুই। অথচ কখনও একসাথে শোয় না ভাস্কর। ও শোবে নিচে। আশ্চর্য, ও কোনদিনও স্বামীর অধিকারে কাছাকাছি আসেনি। একদিন প্রশ্ন করি, ভাস্কর তুমি আমার পাশে শোও না কেন? আমি কি তোমার যোগ্য নই। ও হ্যাঁ, কাল থেকে আমার সাথে অফিসে যাবে। আমি মেয়েমানুষ, একা আমার পক্ষে যাওয়া-আসায় সমস্যা হচ্ছে। তোমার সাহায্য প্রয়োজন।
ঠিক আছে যাবো।
সারাদিন অফিসে-বাইরে কাজ করে ভাস্কর। সবকিছু দেখভাল করে। এতটুকু ক্লান্তি নেই। একসাথে ফিরি।
কিভাবে চলে ভাস্কর। একটি টাকাও কোনোদিন চায়নি। বাসায় খায়, ঘুমায়। স্বামী কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও বড্ড একা আমি। ও স্পর্শ করেনি কখনও। এ কেমন ছেলে।
সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছিল মাঝরাতে। ওপরে ফ্যান-এসি দুটিই চলছিল। ঠান্ডায় ঘুম ভাঙে। দেখি নিচে ভাস্কর ঠান্ডায় কাঁপছে। এসি অফ করি। ফ্যানের স্পিড কমিয়ে দিই। কী ভেবে আমি নিচে ভাস্করের পাশে শুই। সেকি কি ঠান্ডা নিচে। কীভাবে নিচে শোয় ভাস্কর! চোখজুড়ে ঘুম আসে। আমি ভাবি, ভাস্কর নিচে শুতে পারলে আমি পারবো না কেন? শুই ভাস্করের পাশে। সাথে-সাথে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই আমি। হঠাৎ মেঘের আচমকা ভয়ংকর গর্জনে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি ভাস্করের বুকে আমি শুয়ে। আমাকে জড়িয়ে ও। মনে হল, সত্যি এটাই নিরাপদ আশ্রয়, স্বামীর বুকে। একজন মেয়ের অবলম্বন হল স্বামীই। আমি ভাস্করের বুকে মুখ গুঁজে শুই।এই প্রথম কোনো পুরুষের গায়ের গন্ধ নাকে এলো। ওর গায়ের গন্ধটা ভারি মিষ্টি এবং চুম্বকের মতো আকর্ষণীয়।
কখন সকাল হল জানি না। আমি নিচে শুইয়ে। পাশে ভাস্কর নেই। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, ভাস্কর টেবিল লাইটের আলোয় কিছু লিখছে। নিশ্চয়ই গল্প না হয় কবিতা। হঠাৎ ওর লেখা থেমে যায়। দেখি বারবার কলম ঝাড়ে। আবার লিখতে চায়। না, কলমের কালি ফুরিয়ে গেছে। আমি ভাস্করের কাণ্ড দেখি। কিছুক্ষণ পর আমার পাশে বসে বলে,
ফুলকি তোমার ঘুম ভাঙছে? একটা কথা বলব?
আনন্দের বাঁধ ভেঙে যায় আমার।
বল।
ভাস্কর চুপ। আমি ওর হাত ধরে বললাম,
কি বলতে চাও, বলো।
আমার একটি জিনিস চাই, দেবে? আমার তো টাকা নেই। কেনার সামর্থ্যও নেই।
বলো কি চাই। এসব যা দেখছ, সব তোমার-আমার। এই প্রথমবার একটা কিছু চাইলে। বলো কি প্রয়োজন তোমার।
আমতা-আমতা করে বলে,
আমার একটা টাচফোন দরকার। মোবাইলে লিখবো, লিখে পত্রিকায় পাঠাবো। আজকাল কারো হাতের লেখা ছাপায় না কেউ। কম দাম হলেও চলবে।
কি বলছ এসব। সব তোমার-আমার। মনে করেছিলাম বড় কিছু চাইবে, চাইলে সামান্য একটা টাচফোন!
আমি জানি, সব তোমার, তোমার বাবার। আমার কিছু নয়।আমি ছোট মানুষ। তোমাদের আশ্রিত একজন। তোমার বাড়ি বসে দয়ায় আদরে খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, এই তো আমার জন্য অনেক পাওয়া। আমি সাধারণ, স্বপ্নও ক্ষুদ্র। ঐ সাত-আট হাজারের ফোন হলে চলবে।
আমি ফুলকি, যার অর্থ স্ফুলিঙ্গ- অগ্নিকণা। ভাস্করের ছোট্ট একটি আবদারে ফুলকির তীব্র অগ্নিকণা নিভৃতে মিলিয়ে গেল।