পাহাড়ি জনপদে শান্তি আসেনি ২৩ বছরেও

ত্রিমুখী সংঘাতে উত্তাল

এন এ জাকির, বান্দরবান :
পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও প্রতিশ্রুত শান্তি ফিরেনি পাহাড়ি জনপদে। গুম, খুন চাঁদাবাজি এখনো পাহাড়ের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিছুদিন পর পর খুন হচ্ছে জেএসএস সন্তু গ্রুপ, সংস্কার গ্রুপ ও সরকারি দলের নেতারা। গত এক বছরে ত্রিমুখী সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২০ জন। এসব খুনের জন্য পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছে একে অপরকে। এখনো হত্যা ও অপহরণ আতঙ্কে ঘর ছাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রামের জনসাধারণ।
এদিকে শান্তিচুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তিতে সরকার ও বাঙালি সংগঠনগুলোর নানা কর্মসূচি থাকলেও চুক্তির পক্ষে কোন কর্মসূচি পালন করছে না চুক্তি সম্পাদনকারী জনসংহতি সমিতি জেএসএস।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে পাহাড়ের সশস্ত্র বাহিনী জনসংহতি সমিতি জেএসএস এর সদস্যদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় দুই হাজার শান্তি বাহিনীর সদস্য খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। সরকার তৎকালীন অস্ত্র সমর্পণকৃত শান্তি বাহিনীর সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দেয় এবং তিন পার্বত্য জেলার জেলা পরিষদকে স্বায়ত্তশাসন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির নিয়োগ দানের ক্ষমতা সরকারি বিভিন্ন বিভাগকে জেলা পরিষদে ন্যস্তসহ ভুমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। বাকি ধারাগুলোও বাস্তবায়নে কাজ করছে বলে জানান সরকারি দলের নেতারা। তবে শান্তি চুক্তির সুফল জেএসএস সদস্যরা ভোগ করলেও পাহাড়ের সাধারণ জনগণ শান্তিচুক্তির সুফল থেকে বঞ্চিত।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, ১৯৯৭ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। যেগুলো বাকি রয়েছে সেগুলোও বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অঞ্চলিক দুই রাজনৈতিক দল জেএসএস এবং ইউপিডিএফ। এই দুই দল চাদাঁবাজি, অপহরণ, হত্যাসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর জন্য আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষ অব্যাহত থাকায় চুক্তির পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক হলেও পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- এখনো কমেনি। পাহাড়ের সন্ত্রাসীরা মানুষকে গুম করবে, হত্যা করবে, অস্ত্র দেখাবে আবার অধিকারের কথা বলবে- তা হবে না। যদি পার্বত্য এলাকার শান্তি চায় তাহলে সন্ত্রাসী কর্মকা- থেকে ফিরে আসতে হবে।
এদিকে শান্তিচুক্তির সুফল ফিরিয়ে আনতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান পাহাড়ি নেতারা।
জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক কেএসমং বলেন. প্রধানমন্ত্রী ও সন্তু লারমার মধ্যে একটি বৈঠক করতে হবে, ওই বৈঠকের মাধ্যমে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হবে, নাকি হবে না, তা পার্বত্যবাসী ও সারা দেশের মানুষকে একটা মেসেজ দিতে হবে। মেসেজ যদি দেয়া না হয় পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা ও বিশ^াস আছে তিনি শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবেন।
শান্তিচুক্তি পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বয়ে আনবে না দাবি করে চুক্তির বিরোধিতা করছে পাহাড়ি সংগঠন ইউপিডিএফ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) আহ্বায়ক ছোটন কান্তিÍ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, শান্তিচুক্তি হয়েছে সরকার এবং জেএসএস এর মধ্যে। তা পরিপুর্ণ বাস্তবায়ন হবে বা জনগণ মুক্তি পাবে, জনগণ উপকৃত হবে তা আমরা মনে করি না। যার কারণে আমরা শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে আসছি। বর্তমানে পার্বত্য এলাকার যে পরিস্থিতি হানাহানি খুনাখুনি হচ্ছে এবং ভূমির উপর নানা আগ্রাসন হচ্ছে এগুলো শান্তিচুক্তির কোন সুফল নয়।
পাশাপাশি বাঙালি সংগঠনগুলোর দাবি- সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষে চুক্তির বেশির ভাগ ধারা বাস্তবায়ন করেছে এরপরও পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ হয়নি। পার্বত্য চট্ট গ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন তেইশ বছরেও শান্তিচুক্তির কোন সুফল পাহাড়ের মানুষ পায়নি। শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেখানে সেনা ক্যাম্পগুলো তুলে নেওয়ার কারণে পাহাড়ে হানাহানি সন্ত্রাসী কর্মকা- বেড়ে গেছে। তবে পাহাড়ে শান্তিশৃখলা রক্ষায় পুনরায় অস্থায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হলে হানাহানি বন্ধ হবে বলে মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ ২৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসেনি। গুম খুন আর চাঁদাবাজির আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। দীর্ঘদিন ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে রক্তপাত বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি মগ লিবারেশন পাটির্, জেএসএস সংস্কার গ্রুপ আর জেএসএস সন্তু গ্রুপের দ্বন্দ্বে উত্তাল পাহাড়ি জেলা বান্দরবান। দুই দশক ধরে পাহাড়ে চাঁদাবাজি গুম খুন অপহরণের সঙ্গে জেএসএস এর সন্ত্রাসীদের দায়ী করে আসলেও সম্প্রতি মগ লিবারেশন পার্টি নামে একটি পার্টির উত্থান হয়েছে বান্দরবানে। আরাকানে সহিংস ঘটনার পর মায়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ পালিয়ে বান্দরবানে অবস্থান নেয়। পরে স্থানীয় কিছু মার্মা যুবককে নিয়ে মগ লিবারেশন পার্টি নামে এ গ্রুপটি বান্দরবানের রুমা থানচি ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গুম খুন চাঁদাবজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে।
পার্বত্য জেলা রাঙামটি ও খাগড়াছড়িতে জেএসএস ও ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দ্বন্দ্বে দীর্ঘদিন ধরে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে আসলেও বান্দরবানে ইউপিডিএফ এর আধিপত্য না থাকায় এ জেলায় জেএসএস এর একক আধিপত্য বিরাজমান ছিল। ফলে চাঁদাবাজি অপহরণের ঘটনা ঘটলেও সশস্ত্র সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনা তেমন একটা ছিল না। কিন্তু বিগত বছর থেকে নব্য সৃষ্ট মগ লিবারেশন পার্টি, জেএসএস সংস্কারপন্থি ও জেএসএস সন্তু গ্রুপের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বান্দরবানেও শুরু হয়েছে সশস্ত্র সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনা।