পরিকল্পনার ফাঁদে বে টার্মিনাল

পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা বে টার্মিনাল। ছবিটি হালিশহর আনন্দবাজার এলাকা থেকে তোলা - সুপ্রভাত

বে টার্মিনালের পরিপূর্ণ নকশা চূড়ান্ত করে কাজ শুরু করা হবে : চবক চেয়ারম্যান#
পরামর্শক নিয়োগের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে : প্রকল্প পরিচালক#
অনুমোদন পায়নি গত বছরের মে মাসে পাঠানো কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের ডিপিপি#

ভূঁইয়া নজরুল :
প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে আগামীর বন্দর বে টার্মিনাল। চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরের চাপ কমিয়ে আনতে বে টার্মিনালে কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য প্রায় এক বছর আগে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হলেও এখন বন্ধ। দুটি ব্লকে মাটি ভরাটের কাজ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। সহসা পরবর্তী কাজ শুরু হওয়ার কোনো লক্ষণও নেই। এমনকি গত বছরের মে মাসে কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি (বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাবনা) পাঠালেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এখন আবার নতুন করে শুরু হবে ডিপিপি তৈরির কাজ।
গত শুক্রবার পতেঙ্গা ইপিজেডের পেছন থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনিঘাট পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ বে টার্মিনাল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুটো ব্লকে মাটি ভরাটের কাজ অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। প্রতিটি ব্লকের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ মিটার ও প্রস্থ ৬০০ মিটার। সাগর থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মাটি এনে এখানে ভরাটের অনুমোদন পেয়েছিল নৌ কল্যাণ সংস্থা। আর নৌ কল্যাণ সংস্থা থেকে এই কাজ নিয়েছে সাইফ পাওয়ার টেকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ই ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এবিষয়ে ই ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ড্রেজিং শাখার ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা দুটি ব্লকে ড্রেজিং প্রায় শেষ করে রেখেছি। শুধু ফিনিশিং এর কাজ বাকি রয়েছে, বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সেই নির্দেশনা না পাওয়ায় তা করা যাচ্ছে না।’
কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য বে টার্মিনালে মাটি ভরাট করা হচ্ছিল। কিন্তু তা অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে কেন জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, ‘কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপিও অনুমোদন হয়নি। এছাড়া বে টার্মিনালের কোথায় কী হবে সেই নকশা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সেটি চূড়ান্ত না হওয়ায় কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ডটি প্রকৃতপক্ষে কোথায় হবে নির্ধারণ করা কঠিন। তাই সেই নকশা চূড়ান্তকরণের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
ডিপিপি অনুমোদন হয়নি কেন?
কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য গত বছরের মে মাসে ডিপিপি পাঠানো হয়েছিল মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এই প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন পায়নি। এবিষয়ে জানতে চাইলে বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহি প্রকৌশলী রফিউল আলম বলেন, ‘ডিপিপি অনুমোদন না করে নতুন করে এর ডিজাইন চূড়ান্ত করতে বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করতে আমরা দরপত্র আহবান করেছি। সেখান থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করতে আরো চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগবে। তারপর তাদের কাজ করার জন্য দিতে হবে আরো সাত থেকে আট মাস। সব মিলিয়ে নকশা পেতেই হয়তো আগামী মে জুন পর্যন্ত সময় চলে যেতে পারে।
ডিপিপি অনুমোদন না হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘২০১৬ সালের পরিকল্পনা দিয়ে তো ২০২০ সালে এসে ডিপিপি অনুমোদন হয় না। এরজন্য সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রয়োজন। আমরা এখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা করবো।’
আগামী জুলাইয়ের আগে এগুচ্ছে না বে টার্মিনাল
এখন বে টার্মিনালের জন্য পরামর্শক নিয়োগের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে। দরপত্র জমা দেয়ার তারিখ আগামী ২২ জুলাই। দরপত্র জমা দেয়ার পর তা যাচাই বাছাই করে একটি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করতে আরো প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগতে পারে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান। এবিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, আন্তর্জাতিক দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে কিছু সময়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই সময়গুলো অতিক্রম করার পর চূড়ান্ত নকশা পেতে আগামী জুন-জুলাই পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
নকশায় কী থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর, বে টার্মিনাল, মাতারবাড়ি, পায়রা ও মোংলা বন্দরের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনা করে পরিকল্পনা করা হবে। সেই পরিকল্পনায় বে টার্মিনালের বিস্তারিত ডিজাইন থাকবে এবং কোথায় কী হবে এবং কখন করতে হবে সেটাও উল্লেখ থাকবে। আর এগুলো পাওয়ার পর আমরা ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো। পাঠানোর পর অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা যাবে। এর আগে নয়।’ এর আগে বে টার্মিনালের কার্যক্রম শুরু জয় ২০১৪ সালের মে মাসে। তখন ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি। একই সময়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) থেকে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের জন্য আবেদনের পর তা পেতে সময় লেগেছে ১৭ মাস। পরবর্তীতে সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ভূমি বরাদ্দ পেতে ৩৩ মাস সময় লেগেছে। ২০১৮ সালের আগস্টে ভূমি বরাদ্দ পাওয়ার পর এখনো পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়েছে।
এখনই প্রয়োজন বে টার্মিনাল
গত দুই বছর আগে বে টার্মিনালের জন্য একটি অংশের ভূমি বরাদ্দ পাওয়ার পরই প্রশ্ন উঠেছিল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি বে টার্মিনালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর সেই হিসেবে তৎসময়ে কাজ শুরু করা হয়েছিল। একইসাথে চট্টগ্রাম বন্দরের উপদেষ্টা কমিটির সভায়ও বে টার্মিনালের বিষয়টি কয়েক দফায় উঠে এসেছে এবং দ্রুত তা শুরু করার জন্যও বলা হয়েছিল। কিন্তু এই প্রকল্পটি কেন অন্যান্য প্রকল্পের মতো এগুচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বে টার্মিনাল প্রকল্পটি এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। আগামীতে বন্দরের যে প্রবৃদ্ধি হবে তা ধরে রাখতে বে টার্মিনাল ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু প্রকল্পটি সেভাবে এগুচ্ছে না। এটা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার বিষয়টিও পরিষ্কার করা প্রয়োজন।’
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে কাজ করেন সাইফ পাওয়ার টেক। বন্দরের ভেতর থেকে যদি কনটেইনার ডেলিভারি না দিয়ে বাইরে বে টার্মিনালে নিয়ে সেখানে থেকে দেওয়া যায় তাহলে বন্দরের কার্যক্রমে আরো গতি পাবে বলে জানান সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আমিন তরফদার। তিনি বলেন, ‘পণ্য ডেলিভারি নিতে প্রতিদিন ট্রাকের সাথে কমপক্ষে চার হাজার মানুষ বন্দরের ভেতরে প্রবেশ করে। যা বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য হুমকি স্বরূপ। এজন্য কনটেইনারগুলোকে বে টার্মিনাল থেকে ডেলিভারি দেয়া হলে ট্রাকগুলোকে যেমন নগরীর ভেতরে প্রবেশ করতে হবে না, তেমনিভাবে বন্দরের সক্ষমতাও বাড়বে।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের আগস্টে বে টার্মিনালের ৬৭ একর ভূমি বরাদ্দ পেয়েছিল। ইপিজেড থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনিঘাট পর্যন্ত সাগরের ভেতরের প্রায় ২৩০০ একর জায়গায় নির্মিত হবে এই বে টার্মিনাল। জোয়ার-ভাটা, দিন-রাত, বাঁকা চ্যানেল কিংবা ড্রাফটের বিবেচনা কর্ণফুলী নদীর জেটিতে ভিড়লেও বে-টার্মিনালের ক্ষেত্রে সেই সীমাবদ্ধতা নেই। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর জেটিতে পৌঁছাতে একটি জাহাজকে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু বে টার্মিনাল নির্মাণ করা হলে তা শূন্য কিলোমিটারের মধ্যেই বার্থিং করতে পারবে। যেকোনো দৈর্ঘ্য ও প্রায় ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে। এখানে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ পরিচালনা করা যাবে। বিদ্যমান পোর্ট জেটিতে একসাথে ১৬টি জাহাজ বার্থিং করা গেলেও বে টার্মিনালে গড়ে প্রায় ৫০টি জাহাজ একইসাথে বার্থিং করা যাবে।