নেকীর শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃতি আনে শা’বান

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

আল্লাহ্ তাআলার জন্য সমস্ত প্রশংসা, গুণগান ও স্তুতি, যিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের মহান ¯্রষ্টা, পালনকর্তা। তিনি জীবনদাতা। তাঁর হুকুমেই সৃষ্টির জন্মমৃত্যু, ক্ষয়Ñলয়। আমাদের জানাÑঅজানা স্থানÑকালÑপাত্র, জীবÑজড়, ছোটÑবড় সবকিছুর উত্থানÑপতন, সৃজনÑবিনাশ তাঁরই ইচ্ছায় সংঘটিত হয়।
যাঁর ইচ্ছাতেই সৃজনÑপালন, তাঁরই তরে সব নিবেদন। আল্লাহ্ এক। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, সবকিছু তাঁরই মুখাপেক্ষী। আমাদের মুক্তির পথনির্দেশক, ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির মহান সংযোজক প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্রই বান্দা ও তাঁর রাসূল।
পবিত্র মে’রাজের অবিস্মরণীয় স্মৃতিবহ মাহে রজব অস্তাচলে। মে’রাজ শরীফের রাত পরবর্তী পবিত্র জুমুআহ্’র দিন আজ। এরই মধ্যে ক্রমে পরবর্তী চান্দ্রমাস শা’বান মাসের আবহ উঁকি দিচ্ছে। মে’রাজ থেকে লাÑমকানের মেহমান, আল্লাহ্র হাবীব আমাদের জন্য পঞ্চাশ থেকে হ্রাসকৃত ‘পাঁচওয়াক্ত’ নামাযের সওগাত এনেছেন। যা পালন করা প্রতিটি মু’মিন নরÑনারীর ওপর ফরয, যারা প্রকৃতিস্থ, বয়ঃপ্রাপ্ত। প্রতিটি নামায আমাদের কাছে মে’রাজ’র স্মৃতি বয়ে আনে, যাতে আমরা হই পুলকিত, উদ্বেলিত। আমাদের পেয়ারা নবী তাই এ নামাযকে ‘মুমিনের মে’রাজ’ বলে অভিহিত করেন। মে’রাজ থেকে আমরা নিয়মিত নামায পালনের জন্য নিজেদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। এটি পালিত হোক নিষ্ঠাসহ, নিয়মিত।
মাহে রজব আমাদেরকে মে’রাজের পুণ্যস্মৃতিতে অবগাহন করায়। নামাযের সাথে সম্পর্ক ঘনীভূত করতে সহায়তা করে। নামাযের মধ্যে তাশাহ্হুদ বা ‘আত্-তাহ্যিয়াতু’ পড়ার বাধ্যকতাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। নামায ও মে’রাজ দু’জনে দু’জনার। নামাযের হালতে নামাযীকে নিজের কলব, অন্তর হাজির রাখতে হয়। হাদীসে জিবরাঈলে নবীজির কাছে জিবরাঈলের ইহ্সান সম্পর্কে জিজ্ঞাসার জবাবে নবীজি ফরমান ‘আল্লাহর ইবাদত এভাবেই করা, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তাঁর দর্শনে সক্ষম নাও হতে পার, তবে এটা তো নিশ্চিত যে, তিনি তোমাকে দেখছেন’। (সূত্র : সহীহ্ বুখারী ও মুসলিম) একমাত্র আল্লাহ্র আমন্ত্রণে লাÑমকানে পৌঁছে আল্লাহ্র দর্শন লাভ তাঁর হাবীব (দ.) ছাড়া আর কোন বান্দার পক্ষেই যে সম্ভব নয়। তাই, নামাযে অন্তত তাঁর ধ্যানÑজ্ঞানকে একাগ্রচিত্তে আত্মস্ত করা সাধারণ মুমিনের জন্য মে’রাজ তো বটেই। আল্লাহ্র কাছে নৈকট্য অনুযায়ী বান্দার গমনাগমন ও দর্শনÑক্ষমতা বিচার্য। তাই নবীর নৈকট্য মোতাবেক তিনি লাÑমকানে, বাকীরা স্বÑস্ব অবস্থান অনুযায়ী। অন্তরের স্থৈর্য অনুযায়ী বান্দাহ্ আল্লাহ্র সমীপে উপনীত হয়।
নামাযের বাধ্যতামূলক নির্দেশনা এসেছে মে’রাজ’র রাতে। তাই নামায মে’রাজের তোহ্ফা বা উপঢৌকন। ফরয নামায আদায় না করা মহাপাপ, আর ফরয বিবেচনা না করা কুফরী। ফরয আদায়ে কর্তব্য পালন হয়; কিন্তু আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ হয় নফল বা অতিরিক্ত নামাযের মাধ্যমে। দিনের বেলা নামায লোক দেখানো হওযার সমূহ আশঙ্কা, রাতের নামাযের আস্বাদন আলাদা, একাগ্রতা ভিন্ন। তাহাজ্জুদ হল রাতের নামায। চুপিসারে লোকচক্ষুর অন্তরালে এ আরাধনা প্রভুপ্রেমের অভিসারই। আমাদের মে’রাজ’র অনুশীলন যমীনে, হাবীবের মে’রাজ লাÑমকানে। তাশাহ্হুদ’র বচনসমূহ আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীব (দ.)র সম্ভাষণ বলা যায়। সেখানে প্রথমোক্ত বাক্যের শব্দত্রয়, যথাÑতাহিয়্যা-ত, সালাওয়াত, ত্বায়্যিবা-ত এবং সালাম, রহমত, বরকত, যা দ্বিতীয়োক্ত বাক্যে আছে, এখানে প্রথম সম্ভাষণ আগন্তুকের, দ্বিতীয়টি আহ্বানকারীর, অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূলÑএর সেখানকার সংলাপই নামাযে সংযোজিত। একাগ্রচিত্ত নামাযী বান্দা যখন আভূমি লুণ্ঠিত হয়ে সিজদায় পতিত হয়, আল্লাহ্ ও তাঁর উপাসনায় আত্মবিস্মৃত বান্দার মধ্যে কোনো অন্তরায় থাকে না। নিরাকার আরাধ্যের স্বরূপ সাকার রূপে তো উদ্ভাসিত হওয়ার নয়; কিন্তু তাঁর আরাধনায় ধ্যানস্থ হতে বাধা কী? শুধু শয়তানের কুমন্ত্রণাকে ডিঙাতে পারলেই হলো।
মে’রাজ শরীফের রাতে সহীহ্ মুসলিম’র বর্ণনায় আল্লাহ্ তাআলা তাঁর হাবীব (দ.) কে সুরা বাকারার শেষ আয়াতদ্বয়ও দান করেছেন। এ তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, ওহী বা পবিত্র কুরআনের বাণী পাওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ্র মাহবুব জিবরাঈল (আ.)র মোটেও মুখাপেক্ষী নন। বরং এতে জিবরাঈল (আ.) তাঁর দায়িত্ব পালনের জন্যই নবীর দরবারে হাজিরা দিতে বাধ্য হন। জিবরাঈল (আ.)’র আগমনে মদীনা মুনাওওয়ারার যমীনের মর্যাদা বর্দ্ধিত হয়েছে, তা নয়, বরং এ দরবারে আগমন করতে পারায় তিনি ‘ফেরেশতাকুল সর্দার’র মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন।
শা’বান মাস সামনে। আগেই বলা হয়েছিল, রজব, শা’বান ও রমাদ্বানÑএ মাসত্রয় তিন মহান রাত নিয়ে আসে। যেগুলো এ উম্মতের জন্য বিশেষ নেয়ামতের প্যাকেজ। যথা, মে’রাজ, বরাত ও কদর’র রাত। রজব মাসে মে’রাজ’র ওপর পর্যাপ্ত আলোকপাত হয়েছে। মুক্তির রজনী বরাত’র সওগাত নিয়ে আসে মাহে শা’বান। শাব্দিক অর্থ যার, শাখাÑপ্রশাখা হওয়া। মাহে রমাদ্বানে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতসহ অজ¯্র কল্যাণ ও বরকতের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এর মোহনায় থাকা মাস বলে শা’বান নামকরণ। এটি হারাম মাস রজব এবং কুরআন অবতরণেও কদরের মাস পবিত্র মাহে রমাদ্বান’র মধ্যবর্তী মাস। তাই এর মর্যাদা, মহিমা ও ব্যাপক। ‘গুনিয়াতুত ত্বাÑলিবীন’ কিতাবে বলা হয়েছে শা’বান শব্দের পাঁচটি বর্ণে বিশেষ পাঁচটি নেয়ামত’র ইঙ্গিত রয়েছে। যথাÑ‘শীন’ শরফ’র (মর্যাদা) দিকে ইঙ্গিত দেয়। আর ‘আইন’ হরফে উলু’ও (উচ্চমান), ‘বা’ তে বার্র (নেকী), আলিফ দ্বারা উলফত (ঐশী প্রেম) এবং ‘নূন’ দ্বারা নূর’(আলো)র প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। এ মহান মাসে ইবাদতÑবন্দেগী, নফল নামায রোযা ইত্যাদি তাওবাপূর্বক আদায় করার মাধ্যমে অতিবাহিত করা হলে বর্ণিত নেয়ামতরাজি অর্জনে আল্লাহ্র বান্দা সক্ষম হবেন।
রমাদ্বানÑপূর্ব মাস বিধায় এ মাস দুটিতে অধিক রোযা পালনের চেষ্টা করা আমাদের উচিত। হযরত আবু হুরায়রা (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ইরশাদ করতে শুনেছি যে, তিনি বলেন, তোমরা শা’বানের রোযা দ্বারা নিজেদের দেহগুলো পবিত্র করে নাও, যাতে রমাদ্বান শরীফের রোযা রাখার উপযোগী হও। অর্থাৎ এ মাসে রোযা (নফল) রেখো রমাদ্বানের ফরয রোযার জন্য। আল্লাহ্র রাসূল মাহে রমাদ্বানের অভ্যর্থনার জন্য এ মাসে অধিকহারে নফল রোযা রাখতেন। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আপনি শা’বান মাসে যে অধিকহারে রোযা রাখেন তেমনটি অন্য কোনো মাসে রাখতে আমি দেখিনি। তিনি ইরশাদ করলেন, এটি এক বরকতময় মাস, যাতে বান্দার আমলসমূহ আল্লাহ্র দরবারে উত্তোলিত হয়। তাই, আমি পছন্দ করি যে, আমার আমল রোযার হালতেই যেন উত্থিত হয়।
এমন পুণ্যময় আবহ অনেকের জীবনেই পরবর্তী বছর আসবে না। সময়কে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ। আগামী বছর আমাদের অনেকেই হয়তো হারিয়ে যাবো। তাওবাÑইস্তিগফার, রোযাÑনামায্, দোয়াÑদরূদ ইত্যাদিতে আসুন অন্তরকে সজীব করে তুলি। আল্লাহ্ তাওফীক দিন, আমীন।

লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব :হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।