নীরব ঘাতক শব্দদূষণ

নিয়ন্ত্রণে বিধিমালা আছে কিন্তু কেউই মানছে না

শব্দ প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাভাবিক শব্দ আমাদের শরীর এবং মনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। শ্রবণশক্তি একটি আশীর্বাদ। শ্রুতিসীমার বাইরে অবাঞ্ছিত শব্দ, মাত্রাতিরিক্ত তীব্রতা, তীক্ষ্ন, কর্কশ, বেসুরো, বিরক্তিকর আওয়াজকে শব্দদূষণ বলে।
সহনশীল মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দের কারণে নগরবাসী পরিশ্রান্ত, বিরক্ত, অবসাদগ্রস্ত। শব্দের সমস্যা হ্রাস পাওয়া তো দূরে থাকুক, হররোজ সেটা প্রকট আকার ধারণ করছে। গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন, কলকারখানার শব্দ, ঢাকঢোলের আওয়াজ, মিছিল মিটিংয়ের শব্দ, মাইক্রোফোনের আওয়াজ, জেনারেটর, রেডিও-টেলিভিশন, নতুন নতুন স্থাপনা তৈরি, স্থাপনা ভাঙার শব্দ, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের শব্দযন্ত্রের ব্যবহার। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা, লটারি, টিকিট বিক্রি, পণ্যের প্রচারণা, রাজনৈতিক সভা-বক্তব্য, বিমানের শব্দ, রেলের শব্দ, পুরনো কলকারখানার যন্ত্রপাতির শব্দ, লক্করঝক্কর যানবাহনের শব্দ, গোষ্ঠীগত কার্যকলাপ, বিভিন্ন হট্টগোল ইত্যাদি।
একটি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নগরের পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হসপিটাল এবং একে খান আল আমিন হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকা দুটি ‘নীরব এলাকা’ শ্রেণিভুক্ত। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এর বিধি ২ (ঞ) অনুযায়ী, এসব এলাকায় দিনের বেলা শব্দের সহনীয় মানমাত্রা হচ্ছে ৫০ ডেসিবল। যা রাতের বেলা ৪০ ডেসিবল এ নির্ধারিত। অথচ এলাকা দুটিতে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগারের রেকর্ডকৃত শব্দের মানমাত্রা হচ্ছে ৭২ দশমিক ৫০ ডেসিবল।
শুধু এলাকা দুটি নয়। শহরের অন্যান্য নীরব এলাকায়ও শব্দের সহনীয় মানমাত্রার চেয়ে বেশি রেকর্ড করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সংস্থাটির গবেষণাগার প্রতিমাসে শহরের ৩০টি স্পটের শব্দের মানমাত্রা পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ১৫টি ‘নীরব এলাকা’, দুইটি ‘মিশ্র এলাকা’, ‘সাতটি আবাসিক এলাকা’ এবং ছয়টি বাণিজ্যিক এলাকা রয়েছে। গত মাসে (ফেব্রুয়ারি) পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে জানা গেছে, সবক’টি এলাকায় শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে নগরবাসী।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, মাত্রাতিরিক্ত এ শব্দদূষণের জন্য গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন, মোটরযানের অতিরিক্ত হর্ন, শিল্পকারখানার মেশিনের শব্দ, বাসাবাড়ি ও শপিং মলে জেনারেটর ও উচ্চ শব্দে মিউজিক বাজানো, নির্মাণ কাজের পণ্য ওঠানামা ও নির্মাণ কাজ চলাকালে সৃষ্ট শব্দ এবং মাইকিং দায়ী। চিকিৎসকরা বলছেন, শব্দদূষণের কারণে বাড়ছে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কার্যকর প্রয়োগ করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মানুষ সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেল শব্দে কথা বলে। ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০-এর বেশি গেলেই ক্ষতি শুরু হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের করা এক জরিপ থেকে জানা যায়, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতিমধ্যেই দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমানে শব্দদূষণের যে মাত্রা, সেটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০২৩ সাল নাগাদ এক তৃতীয়াংশ মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হবে। তারা বধিরতায় আক্রান্ত তো হবেই, পাশাপাশি ক্ষুধামান্দ্য, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোযোগী হতে না পারা, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করাসহ হৃদ্রোগের সমস্যাও হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে, সেখানে বিস্তারিত বলা আছে, কোনো এলাকায় দিনের কোন সময়ে কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। কিন্তু বলতে গেলে কেউই মানছে না এ নিয়ম।