নজিরবিহীন মানবিক সংকটে গাজা

সুপ্রভাত ডেস্ক »

ইসরায়েলি বিমান হামলায় নজিরবিহীন মানবিক সংকটে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের মিডিয়া বিভাগ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে।হামাসের সালামা মারুফ বলেছেন, হতাহত, অবকাঠামো ধ্বংস এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে গাজায়। ইসরায়েলের আগের আগ্রাসনে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি।তিনি অভিযোগ করেছেন, মানবিক পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া আরও কমে গেছে।

ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নির্মূলের প্রচেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ করেন হামাসের এই সদস্য। ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তা কামনারও আহ্বান জানান তিনি। খবর বিবিসি, আল জাজিরা।এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র মারগারেট হ্যারিস বলেছেন, ইসরায়েলি বোমা হামলায় গাজায় মানবিক করিডোর স্থাপন হয়নি। গাজার ৪৪টির বেশি হাসপাতালকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। ৮৪ হাজার অন্তঃসত্ত্বা নারীকে সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।

যেকোনও সময় উত্তর গাজায় অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। জীবন বাঁচাতে দক্ষিণ দিকে ছুটছে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। জ্বালানি, খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় এক হাজার ৩০০ ইসরায়েলি প্রাণ হারান। জবাবে গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলায় এ পর্যন্ত ২ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

গাজায় রাশিয়ার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বাতিল নিরাপত্তা পরিষদে
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি চেয়ে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল রাশিয়া, তা বাতিল করেছে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদ। সোমবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জাতিসংঘের নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন। খবর ঢাকা পোস্টের।

নেবেনজিয়ার উত্থাপিত সেই প্রস্তাবে গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে বেসামরিক লোকজনকে হত্যার নিন্দা জ্ঞাপনের পাশাপাশি হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েল ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মুক্তি, মানবিক সহায়তা করিডোর গঠন এবং বেসামরিকদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য সেফ প্যাসেজের দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, সোমবারের বৈঠকে প্রস্তাবটি উত্থাপনের পর নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী-অস্থায়ী ১৫ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ৪টি রাষ্ট্র এটির পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অপর ৪টি রাষ্ট্র এর বিপক্ষে ভোট দেয়; আর ভোটদান থেকে বিরত থাকেন বৈঠকে উপস্থিত অপর ছয় সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের গাজা ভূখ- নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ ছিল নিরাপত্তা পরিষদের সোমবারের বৈঠকের মূল ইস্যু। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধি কূটনীতিকরা জানিয়েছে, বৈঠকে রাশিয়ার পাশাপাশি ব্রাজিলও এই ইস্যু সংক্রান্ত খসড়া একটি রেজোল্যুশন উত্থাপন করেছে এবং সেটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি। ব্রাজিলের সেই রেজোল্যুশনে এই হামালার জন্য হামাসকে নিন্দা জানানো হয়েছে।

কূটনীতিকরা আরও জানিয়েছেন, আজ মঙ্গলবার প্রস্তাবটি চুড়ান্ত আকারে পরিষদের বৈঠকে তোলার কথা রয়েছে।

সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ভোটের পর জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ‘আমাদের রেজোল্যুশন পাস হয়নি, তবে এর মধ্যে দিয়ে এই যুদ্ধ নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে সক্রিয় হলো নিরাপত্তা পরিষদ। যদি আমরা উদ্যোগ না নিতাম, সেক্ষেত্রে সবকিছুই কেবল আলাপ-আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত।’

ভোটপর্বে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রুশ প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেয় পরিষদের অন্যতম স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য। এই পর্ব শেষ হওয়ার পর জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড রাশিয়ার সমালোচনা করে বলেন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করেই এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছে রাশিয়া এবং এই প্রস্তাবে যুদ্ধের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে ঐকমত্য গঠনের ব্যাপারটিকেও হালকা ভাবে নেওয়া হয়েছে।

‘আমরা এমন কোনো রেজোল্যুশনকে সমর্থন করতে পারি না, যা হামাসের সন্ত্রাসী হামলাকে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়,’ বলেন বারবারা উডওয়ার্ড।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান বলেন, ‘যে কোনো প্রকার মানবিক সহায়তা, যুদ্ধবিরতি বা শান্তি স্থাপনের আগে নিরাপত্তা পরিষদের উচিত হবে হামাসের নিন্দা জানানো।’

প্রায় দুই বছর ধরে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়ার পর ৭ অক্টোবর ভোররাতে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে একের পর এক রকেট ছোড়া শুরু করে হামাস এবং সূর্যের আলো ফোটার আগেই ইসরায়েলের দক্ষিণাংশের সীমান্ত বেড়া বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ওই ভূখ-ে প্রবেশ করে শত শত সশস্ত্র হামাস যোদ্ধা।

প্রাথমিক গোয়েন্দা তথ্য ও প্রস্তুতির অভাবে হামলার শুরুর দিকে খানিকটা অপ্রস্তুত থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা কাটিয়ে পূর্ণ শক্তিতে যুদ্ধের ময়দানে নামে ইসরায়েল এবং প্রথম দিন থেকেই গাজায় বিমান হামলা শুরু করে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

হামাসের হামলায় প্রথম দিনই ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন কয়েকশ ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক। এছাড়াও দেড় শতাধিক মানুষকে এদিন জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে হামাস। এই জিম্মিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা এখনও অজানা।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ দিনের এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪শ’রও বেশি ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক; আর গাজা উপত্যকায় নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ২ হাজার ৮৩৭ জনে।

গাজায় আহত ১১ হাজার
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেছেন, গাজায় ১১,০০০ মানুষ আহত হয়েছে, যাদের অর্ধেক নারী ও শিশু।সংস্থাটি বলেছে, গাজায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে ১১৫টি হামলা হয়েছে এবং তাদের রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। খবর বাংলানিউজের।

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। জবাবে গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলে এক হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছে, আর আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৫০০ জন।

এদিকে গাজায় সোমবার পর্যন্ত দুই হাজার ৮০৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়েছে ১০ হাজার ৮৫৯ জন।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ নারী ও শিশু। এর মধ্যে ৩৭ চিকিৎসাকর্মী, চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিকস রয়েছেন।

ইসরায়েল-হামাস সংঘাতে পশ্চিম তীরেও ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অধিকৃত পশ্চিম তীরে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৫৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আর হয়েছে এক হাজার দুইশরও বেশি।

ইসরায়েল এখন গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। সেখানে পানি, বিদ্যুৎ ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বহু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ইসরায়েল গাজা সিটিসহ উত্তর দিকের বাসিন্দাদের এলাকা ছাড়তে বলেছে।

গাজায় জরুরি প্রবেশাধিকার চায় ডব্লিউএইচও
গাজায় ত্রাণ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রবেশাধিকার চেয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গাজায় দীর্ঘ-মেয়াদে মানবিক সংকট দেখা দেওয়ার সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসংঘের এই সংস্থাটি।

ডব্লিউএইচও’র পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় আঞ্চলিক কার্যালয়ের জরুরি সেবা পরিচালক রিচার্ড ব্রেনান বলেছেন, সংস্থাটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাজায় অবাধে প্রবেশের ব্যবস্থা করতে মঙ্গলবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছে।

মিশরের সঙ্গেকার রাফাহ সীমান্ত ক্রসিংয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা রাফাহর দক্ষিণে ত্রাণ নিয়ে গেছি। গাজায় প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছি।’ গাজায় জরুরি ত্রণ সরবরাহের জন্য রাফাহ ক্রসিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ রুট।

৭ অক্টোবর গাজা থেকে ইসরায়েলে হাজার হাজার রকেট ছোড়ে হামাস। সেইসঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালায় হামাস যোদ্ধারা। এ সময় তারা বহু ইসরায়েলিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়।

হামাসের হামলায় নিহত হয় ১৪০০’র বেশি ইসরায়েলি। হামাসের হামলা শুরুর দিনই গাজায় পাল্টা বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এর পর থেকে টানা চলে আসছে হামলা। ইসরায়েলের বিমান হামলায় গাজায় ২ হাজার ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে।

ইসরায়েল হামাসকে নির্মূলে স্থল অভিযান চালানোর আগে দিয়ে গোটা গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এতে সেখানে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।

ডব্লিউএইচও বলছে, গাজায় তিনদিনের জন্য পণ্য সরবরাহের প্রস্তুতি আছে। কিন্তু ত্রাণকর্মীরা তা সরবরাহ করতে পারছে না।
ব্রেনান বলেন, ‘ডব্লিউএইচও যে কোনও সংঘাতেই সব পক্ষকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আবেদন অনবরতই জানিয়ে আসছে।’