তরুণ প্রজন্মের স্বার্থে রাজনীতির পরিবর্তন জরুরি

রায়হান আহমেদ তপাদার »

আমাদের দেশের রাজনীতি এবং গণতন্ত্রচর্চা নিয়ে কিছু বলতে গেলে হতাশ না হয়ে উপায় নেই। এখন বলতে গেলে, গণতন্ত্রের চর্চা কোনো দলের মধ্যেই দেখতে পাই না। এটা যে শুধু সরকারি দলের মধ্যেই খারাপ অবস্থা, তা নয়। সার্বিকভাবে বলতে গেলে কোনো দলের মধ্যেই গণতন্ত্রের সুষ্ঠু ও সুন্দর চর্চা পরিলক্ষিত হয় না। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় নেই। কারণ আদর্শের জায়গা থেকে তো রাজনীতি করা হয় না। এখন রাজনীতি করা হয় স্বার্থ ও ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্য আর সুবিধাজনক পক্ষপাত থেকে। কাজেই রাজনীতি ও গণতন্ত্র নিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা হলে বা জানতে চাওয়া হলে বেশির ভাগ মানুষই বলে ‘ভালো’ কথাটা বলা কঠিন। অতীতে আমরা দেখেছি, বিরোধী দলের কী ঐতিহ্য ও দাপট ছিল। যে দলেরই সংগঠন হোক, তারা রাজপথে নেমে অনেক দাবি আদায় করে তবেই ঘরে ফিরত। এখন জাতীয় কোনো সমস্যা বা সামাজিক জরুরি বিষয়ের দাবি উত্থাপন এবং তা আদায় করার জন্য চেষ্টা ও আন্দোলন-কিছুই দেখা যায় না। সামান্য আলোচনা ও সমাবেশ হয়তো হয়; কিন্তু সেই আন্দোলন বড় কোনো কাজে ভিড়তে পারে না। সোজা কথায়, এখন বিরোধী দলের বলার মতো কোনো ভূমিকা ও প্রভাব নেই। অথচ গণতন্ত্র মানেই বিরোধী দল থাকতে হবে। এসব যেহেতু বিরাজমান নেই তাই আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার কাজটি তাদের নিজেদেরই করতে হবে এবং ভুলে যেতে হবে ব্যর্থ নেতৃত্বের দিকে ফিরে তাকানোর অভ্যাস।
বিগত দিনের নেতারা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে। তরুণরা যখন সামনে তাকাচ্ছে তখন তারা কোনো আশাপ্রদ ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না। আমাদের শিক্ষিত তরুণদের এ কথা জানা উচিত যে, রাজনীতি হচ্ছে শাসন করার বুদ্ধিমত্তার আলোকিত প্রক্রিয়া। সেখানে ব্যক্তির খেয়াল-খুশির কোনো জায়গা নেই। রাজনীতি বলতে কী বোঝায় সে সম্পর্কে দার্শনিক প্লেটো থেকে শুরু করে রুশো এবং আরো অনেকের শিক্ষাই আমরা লাভ করেছি। দুর্বৃত্তপনা, প্রতারণা, দুর্নীতি তথা জনগণের অর্থ লুটপাট করাকে রাজনীতি বলে না। একজন রাজনৈতিক নেতার যেমন গভীর জ্ঞান থাকতে হয়, তেমনি থাকতে হয় জনগণের প্রতি প্রবল দায়িত্ববোধ। গণতন্ত্র ধ্বংসের রাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়া জনজীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেনি। নীতিহীন বিভক্তিকরণের রাজনীতির কর্মী হওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কিংবা শিক্ষকদের কোনো প্রকার দ্বিধা বা অনীহা দেখা যায়নি। সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকার পরও ছাত্রনেতারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টর্চার সেল’ গড়ে তুলতে পেরেছে। এর ফলে অচিন্ত্যনীয় ক্ষতি হয়েছে উচ্চশিক্ষার। ছাত্র-শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবসময় বিরাজ করছে বিরোধ-বিদ্বেষের পরিবেশ, যা মোটেও লেখাপড়ার অনুকূল নয়। একে দেশের কিংবা ছাত্রদের ভবিষ্যতের জন্য শুভ ও সুস্থ রাজনীতি বলা যায় না।
যারা বিত্তবান হওয়ার ব্যবসাকে রাজনীতি হিসেবে দেখেন তারা আসলে সুন্দর সমাজের জন্য যা কিছু শুভ ও কল্যাণকর তার সব কিছুরই শত্রু। দলীয় রাজনীতি যখন রাজনীতি পদবাচ্য নয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির সংস্পর্শ পরিত্যাগ করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের করতে হবে জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতির অনুশীলন। দেশের বিভিন্ন এলাকার ছাত্রদের একটি বিরাট অংশ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এদের অনেকেই আবার কলেজের গ-িতে এখনও পা রাখেনি। স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতির খাতায় নাম লিখিয়েছে। দলে দলে মোটরসাইকেল নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ায়। চুলে বিশেষ ধরনের ছাঁট। পোশাকে একটা আলট্রা মডার্ন ভাব। নেতারা এদের মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। যতটা রাজনীতির দিকে এদের আগ্রহ, ঠিক ততটাই অনাগ্রহ পড়াশোনার দিকে। স্কুলগামী ছাত্ররা রাজনীতির খাতায় নাম লেখানোয় পড়াশোনায় ভাটা পড়েছে। বর্তমান সরকার শিক্ষা খাতে নানাবিধ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু দূষিত রাজনীতির বিষবাষ্প অনেকটাই সেই সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, এ সাফল্য আরও বেশি হতে পারত; যদি ছাত্ররা অধ্যয়নকেই তপস্যা হিসেবে নিত। কিন্তু নেতার নামে স্লোগান দিলে ‘টু-পাইস’ পাওয়া যায়, এলাকার টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে ভাগ বসানো যায়-এসব কারণে এ ধরনের ছাত্ররা এখন পড়ালেখার চেয়ে রাজনীতিতেই বেশি আগ্রহী। এরা কোনো আদর্শ দ্বারা তাড়িত নয়। নগদ প্রাপ্তির আশায় এরা রাজনীতি করে; দলবাজি করে। তরুণ প্রজন্মের একটি বিশাল অংশকে এ সর্বনাশা প্রবণতা থেকে রুখতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ আরও জটিল ও কঠিন হয়ে উঠবে।
রাজনীতির মূল বিষয় হচ্ছে, মানুষের কল্যাণ চিন্তা। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সব সময় সমাজের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর থাকে। কিন্তু এখনকার তরুণদের মধ্যে যারা রাজনীতি করে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে তাদের অনেকের মধ্যেই এ প্রতিবাদী মানসিকতা নেই। সহপাঠী নির্যাতনের শিকার হলে তারা পাশে দাঁড়ায় না। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনকারীর ভূমিকা নেয়। এর কোনো দলভেদ নেই। সব দলেই একই অবস্থা। একশ’ ছেলে মিলে এক নেতার পক্ষে স্লোগান দিতে লোকের অভাব হবে না।কিন্তু একটি ভালো কাজে একজনকেও খুঁজে পাওয়া ভার। এরা পড়াশোনার প্রতি দারুণভাবে উদাসীন। ক্লাব, সমিতি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতেও এদের আগ্রহ কম। একটি লাইব্রেরি চালাতে গিয়ে দেখেছি, হাতের কাছে বই পেয়েও খুব কম ছেলেমেয়েই তার সুযোগ নিচ্ছে।
এভাবে রাজনীতি ক্রমেই মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা দেখতে পাই-ছাত্রজীবন থেকেই কতটা সমাজ সচেতন ছিলেন তিনি। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। কলেজে পড়ার সময় তিনি তার নিজের রুমটি ছেড়ে দিয়েছিলেন অন্য ছাত্রদের থাকার জন্য। এ ত্যাগী মানসিকতার পরিচয় জীবনে তিনি বহুবার বহুভাবে দিয়েছেন। এভাবেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি।
কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম ত্যাগ স্বীকার করতে ততটা প্রস্তুত নয়। আসলে সর্বত্র রাজনীতিকরণের নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে রাজনীতিই হয়ে উঠেছে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। এ জন্য গ্রামের একজন স্কুলপড়ুয়া ছাত্রও রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর নেতারাও তাকে সানন্দে দলে ভিড়িয়ে নেয় দল ভারি করার জন্য। আমাদের রাজনীতি কি সঠিক পথে চলছে? ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ’র মতো রাজনীতিও কি তার পথ হারায়নি? নইলে এত রক্ত, এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত একটি দেশের রাজনীতিকরা কেন অযথাই হিংসা-হানাহানিতে লিপ্ত! কেন দেশের কল্যাণ চিন্তার চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠে? রাজনীতিকে কেন ব্যবহার করা হয় ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে? বঙ্গবন্ধু তো রাজনীতির জন্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ ৪৯ বছরে আর একটিও উদাহরণ কেন পাওয়া গেল না? রাজনীতি থেকে আদর্শবাদ লুপ্ত হতে বসেছে। পরমতসহিষ্ণুতা ও সমঝোতার রাজনীতি আজ নেই বললেই চলে। ক্ষমতায় যাওয়া হচ্ছে মানুষের সেবা করার সুযোগ পাওয়া। সেই সুযোগ পেতে এত জোর-জবরদস্তি কেন? আমাদের দেশের রাজনীতির অবস্থা আজ এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির মূল লক্ষ্য যদি দেশসেবা হয়, তাহলে সেই সেবক হওয়ার জন্য তো এত কূটকৌশলের প্রয়োজন পড়ে না। মানুষই তো তাদের সেবক নির্বাচন করবে। এ নিয়মতান্ত্রিকতার পথে চললে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে।
যদিও দুর্নীতির মহামারি কিংবা অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কর্তব্য থেকে সরে থাকতে বলতে পারি না। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যে শূন্যতা বিরাজ করছে তা পূরণ করতে এগিয়ে আসতে হবে নতুন প্রজন্মকে। যদি তারা বর্তমানকে রূপদান না করতে পারে তাহলে তাদের এবং এই দেশের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে না। তরুণদের উপলব্ধি করতে হবে যে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতে নিরাশায় আচ্ছন্ন । তাই তাদের তারুণ্যের শক্তি ও উদ্দীপনাকে ব্যবহার করতে, রাজনীতিতে সম্মান ও মর্যাদাবোধ এবং নিঃস্বার্থ জনসেবার আদর্শ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। তরুণদের অবশ্যই মর্যাদাবোধের অধিকারী হতে হবে। মর্যাদাবোধের অভাব আমাদের জাতীয় সমস্যা। মুজিববর্ষে নতুন করে শপথ নিতে হবে, যাতে জনকল্যাণই মুখ্য বিষয় হয় রাজনীতির। অনিশ্চিত অন্ধকারের পথে আর এক মুহূর্ত নয়। হীনস্বার্থ নয়; সংঘাত, সহিংসতা ও বৈরিতা নয়। একটি সুখী-সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুসহ সব শহীদের রক্তঋণ শোধ করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতেই হবে। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে নির্বাচন ব্যবস্থাকে বিতর্কমুক্ত রাখতে হবে। গ্রাম বা শহর, সবার চাওয়া-পাওয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এ প্রত্যাশা। মানুষের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে রাজনীতিকদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক-এটিই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স