পলি জমে নাব্যতা সংকট, জেগেছে ডুবোচর
এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া :
উৎপত্তিস্থল বান্দরবানের আলীকদম পাহাড় থেকে নিম্নাঞ্চল কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী সমুদ্র চ্যানেল পর্যন্ত মাতামুহুরীর আয়তন ১শ ৪৮ কিলোমিটার। পাহাড়ের আকাবাঁকা পথ পেরিয়ে নদীটি মিলিত হয়েছে সাগর চ্যানেলে। তৎমধ্যে চকরিয়ার বেতুয়াবাজার সেতু পয়েন্ট থেকে নদীর গতিপথ প্রবাহিত হয়েছে দুইদিকে। একটি চলে গেছে বদরখালী সমুদ্র চ্যানেলে, অপরটি কৈয়ারবিল কোনাখালী হয়ে মিলিত হয়েছে পেকুয়ার উজানটিয়া দিয়ে ওপারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি সাগর চ্যানেলে। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা থেকে পাহাড়ে উৎপত্তি হওয়া চকরিয়া উপজেলার বুকচিরে প্রবাহিত মাতামুহুরী নদী একসময় জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে আশীর্বাদ হলেও বর্তমানে মরণদশায় পরিণত হয়েছে। নদীর উজানে লামা ও আলীকদম উপজেলার পাহাড় থেকে পাহাড়ে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও অপরিকল্পিত পাথর আহরণের ফলে প্রতিবছর বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সঙ্গে নেমে আসা পলি জমে মাতামুহুরী নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।প্রাকৃতিক বৈরি আচরণের ফলে মাতামুহুরী নদী বর্তমানে ভয়াবহ নাব্যতা সংকটে পড়েছে। এ অবস্থার কারনে গভীরতা কমে যাওয়ায় গেল দুইযুগের অধিক সময় থেকে ১শ৪৮ কিলোমিটার আয়তনের মধ্যে অন্তত ৭০ কিলোমিটার জনবসতিপুর্ণ এলাকাজুড়ে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ডুবোচর জেগে উঠেছে। এতে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক চলাচল বিঘিœত হবার কারণে প্রতিবছর বর্ষাকালে দুইতীর উপচে লোকালয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ঢলের পানি। এতে অব্যাহত রয়েছে ভাঙনের ভয়াবহতা।
এভাবে বছর বছর ভাঙন তা-বে ক্রমান্বয়ে ছোট হচ্ছে চকরিয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ। ফলে নদী ভাঙন আতঙ্কে ভুগছেন তীর এলাকায় বসবাসরত লক্ষাধিক বাসিন্দা। পাশাপাশি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, একাধিক গ্রামীণ সড়ক, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা,এতিমখানাসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগ তুলেছেন, প্রতিবছর ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোটি কোটি টাকা বরাদ্দে উন্নয়ন কাজ অব্যাহত রাখলেও জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিতে স্থায়ীভাবে টেকসই কোনধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অস্থায়ী প্রকল্প গ্রহন করার কারণে নদীর ভাঙনের তীব্রতায় তা বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তবে কক্সবাজার ও বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, মাতামুহুরী নদীর ভাঙন প্রতিরোধে একাধিক টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উর্ধ্বতন দপ্তরে ইতোপূর্বে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দের অভাবে চকরিয়া উপজেলার অধিক ঝুঁিকপুর্ণ এলাকায় টেকসই ও বড় আকারের প্রকল্প নেয়া যাচ্ছেনা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী ভাঙনের কবলে চরম হুমকির মুখে পড়েছে উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নস্থ বাটাখালী ব্রিজের উত্তরপ্রান্তে নাপিতের টোড়া, পৌরসভার ১নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল বারী পাড়া, ছাবেতপাড়া, চরপাড়া, কাজীরপাড়া, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তরছঘাটা, জলদাশপাড়া ও বাটাখালী সেতুর দুই পাশের গ্রামের বসতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আবাদি জমি। এছাড়াও নদী ভাঙনের তা-বে পড়েছে বিএমচর ইউনিয়নের বেতুয়াবাজার সেতু পয়েন্ট, কন্যারকুম, কুরিল্যার তলা, বরইতলী ইউনিয়নের পহরচাঁদা, গোবিন্দপুর, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের খিলছাদক, লামারপাড়া, মন্ডলপাড়া, জলদাসপাড়া, পূর্ববড় ভেওলার সেকান্দর পাড়া, শমসু মিয়ার বাজারস্থ জলদাশপাড়া পয়েন্ট, কোনাখালী ইউনিয়নের কাইদ্যার ডিয়া, বাংলা বাজার, সিকদাপাড়া পয়েন্ট ও চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগর ঘোনাস্থ বুড়িপুকুর পয়েন্টেসহ একাধিক জনপদ।স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, মাতামুহুরী নদীর ভয়াবহ ভাঙন তা-বে গেল দুইযুগে বসতি হারিয়ে অন্তত ১২হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছেন। গৃহহারা এসব পরিবার বেঁচে থাকার তাগিদে ঠাঁই নিয়েছে বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে। নদীতে বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে পৌরসভার গুরুত্বপুর্ণ শহররক্ষা বাঁধ, ছিকলঘাটা- কৈয়ারবিল সড়ক, ভাঙারমুখ ফাঁসিয়াখালী ঘুনিয়া সড়ক ও কোনাখালী-বাংলা বাজার-বদরখালী সড়ক।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো.আলমগীর চৌধুরী বলেন, উত্তর কাহারিয়াঘোনা খোন্দকারপাড়ার কয়েক হাজার মানুষের পৈত্রিক ভিটেবাড়ি, কবরস্থান, মসজিদ-মাদ্রাসা ও চাষাবাদের শত শত একর ধানি জমি মাতামুহুরীর নদী গ্রাসে বিলীন হতে চলেছে। সাধারণ মানুষ ও স্কুল কলেজ এবং মাদ্রাসাপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের এই পথটির মাঝখানের অংশ মাতামুহুরী নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পৌরবাসীকে রক্ষাকল্পে অধিক ঝুঁিকপুর্ণ পয়েন্টে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে জানানো হয়েছে। কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শওকত ওসমান বলেন, মাতামুহুরী নদী সৃষ্টির পর থেকে কাকারাবাসী নদীর ভাঙনের তান্ডবের কবলে পড়ে ইউনিয়নের বিপুল বসতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত রয়েছে প্রতিবছর।
লক্ষ্যারচর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা কাইছার বলেন, তার ইউনিয়নে মাতামুহুরী নদীর তীর এলাকায় রয়েছে ৬হাজার মানুষের বসবাস। নদী ভাঙনের ফলে জনগনের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে বেড়ে যায় আতঙ্কের মাত্রা। ভাঙন অব্যাহত থাকলে নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে ৩৩ হাজার কেভি’র বিদ্যুৎ লাইনের টাওয়ারসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। জানতে চাইলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা শাখা কর্মকর্তা (এসও) শাহ আরমান সালমান বলেন, ভাঙন প্রতিরোধে পাউবো ইতোপুর্বে অনেকগুলো প্রকল্পপ্রস্তাবনা তৈরি করে অর্থবরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট উধর্বতন দপ্তরে পত্র প্রেরণ করা হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ না হওয়ায় সবখানে একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব হচ্ছেনা।পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থবরাদ্দ সংস্থান হলে নদীর অন্য পয়েন্টে ভাঙন রোধে কাজ করা হবে। চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, মাতামুহুরী নদীর ভাঙনে গেল দুইযুগের অধিক সময়ে অন্তত ১২ হাজার পরিবার গৃহহারা হয়েছে। এখনো উপজেলার বিভিন্ন জনপদে তা-ব অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে অনুরোধ করেছি, যত দ্রুত সম্ভব অধিক ঝুঁিকপুর্ণ জনপদে টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চকরিয়াবাসীকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করুন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।