চট্টগ্রামে তৈরি হচ্ছে বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপের অ্যান্টিভেনম

সুপ্রভাত ডেস্ক »

গবেষণাটি সফলভাবে শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশে তৈরি প্রথম সাপের অ্যান্টিভেনম। প্রাথমিকভাবে ল্যাবেই এটি তৈরির চেষ্টা চলছে। বিষের তীব্রতার দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষধর সাপ চন্দ্রবোড়া; যা রাসেল ভাইপার নামেও পরিচিত। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পদ্মা তীরবর্তী জেলা ও চরাঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দেশে এই সাপের বিষের শতভাগ কার্যকরী কোনো প্রতিষেধক নেই। আশার কথা হলো, প্রথমবারের মত চন্দ্রবোড়া সাপের অ্যান্টিভেনম বা প্রতিষেধক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে। এই মারাত্মক বিষধর সাপের প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) তৈরির কাজ করছে ভেনম রিসার্চ সেন্টার (ভিআরসি) বাংলাদেশ ও অ্যানিমেল ইমিউনাইজেশন ল্যাব।

ভেনম রিসার্চ সেন্টার-এর প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর অধ্যাপক ড. অনিরুদ্ধ ঘোষ টিবিএসকে বলেন, অ্যান্টিভেনম তৈরি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রায় শতবর্ষ পুরানো একটি প্রক্রিয়ায় এটি তৈরি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনম ভারতের ৪ প্রজাতির সাপের বিষের বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশের বিষধর সাপগুলোর বিষ ভারতীয় সাপের থেকে আলাদা, যে কারণে আমাদের এমন একটি অ্যান্টিভেনম দরকার যা আমাদের স্থানীয় প্রধান সাপগুলোর বিষের বিরুদ্ধে কার্যকরী।

এই চেষ্টার প্রথম প্রদক্ষেপ হিসেবে চন্দ্রবোড়া সাপের অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ শুরু করেছি আমরা। প্রথমবারের মতো আমরা ল্যাবেই অ্যান্টিভেনম তৈরির চেষ্টা করছি। প্রমাণ করতে চাই যে, আমরা এটা করতে পারি। এ জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে,’ বলেন ড. অনিরুদ্ধ।

চন্দ্রবোড়ার বিষ কতটা মারাত্মক?
ভারতে প্রতি বছর যে পরিমাণ সর্প দংশনের ঘটনা ঘটে তারমধ্যে অন্তত ৪৩% এবং শ্রীলঙ্কায় প্রতি বছর মোট সর্প দংশনের ঘটনার ৩০-৪০% চন্দ্রবোড়া বা রাসেল ভাইপারের কারণে হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে এই সাপ ও দংশনের সংখ্যা বাড়ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসানের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৭টি জেলাতেই চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষ করে দেশের উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেই এই সাপের উপস্থিতি বেশি।
চিকিৎসকরা জানান, চন্দ্রবোড়া সাপ তিন ধরনের বিষ প্রয়োগ করে শিকারকে ঘায়েল করে। এই সাপের কামড়ে শরীরের দংশিত অংশে বিষ ছড়িয়ে অঙ্গহানি, রক্ত জমাট বাঁধা, স্নায়ু বৈকল্য, পক্ষাঘাত, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রকম শারীরিক উপসর্গ দেখা যেতে পারে।

ভিআরসি’র গবেষণা সহযোগী মো. মিজানুর রহমান বলেন, “ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক এলাকার চন্দ্রবোড়া সাপের বিষের গঠনগত চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন হয়। ফলে ভারতে তৈরি ভেনম অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশের চন্দ্রবোড়ার বিষের বিপরীতে প্রতিষেধক হিসেবে ভালো ফল দেয় না।

ড. অনিরুদ্ধ বলেন, চন্দ্রবোরা সাপের বিষ অনেক বেশি মারাত্মক। এটি সরাসরি কিডনি বিকল করতে পারে এবং কখনও কখনও স্নায়ু অবশকারী উপসর্গ তৈরি করে। এই সাপের বিষ মূলত শরীরের রক্ত জমাট বাঁধা প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমরা এটির প্রতিষেধক তৈরির কাজ শুরু করেছি।

যেভাবে তৈরি হবে বিষধর চন্দ্রবোড়ার অ্যান্টিভেনম
‘ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রি-ক্লিনিকাল সেফটি অ্যান্ড এফিশিয়েন্সি স্টাডি অব টু নভেল মনোভ্যালেন্ট গোট আইজিজি অ্যান্ড চিকেন আইজিওয়াই অ্যান্টিভেনমস ফর দ্য ট্রিটমেন্ট অব রাসেলস ভাইপার এনভেনমিং ইন বাংলাদেশ’- নামের একটি প্রকল্পের আওতায় দেশে প্রথমবারের মতো অ্যান্টিভেনম তৈরির গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘অ্যানিমেল ইমিউনাইজেশন ল্যাব’।

ভিআরসি-র কো-ইনভেস্টিগেটর ড. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ জানান, প্রথমে চন্দ্রবোড়ার নির্দিষ্ট পরিমাণ ভেনম কিছু নির্দিষ্ট প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে তাদের শরীরে এন্টিবডি তৈরি করা হবে। পরবর্তী ধাপে ওই প্রাণী থেকে সিরাম সংগ্রহ করে তৈরি করা হবে চন্দ্রবোড়া সাপের অ্যান্টিভেনম।
তিনি বলেন, ‘সাপের অ্যান্টিভেনম তৈরির জন্য যে প্রযুক্তি প্রয়োজন সেটি বর্তমানে আমাদের দেশে নেই। ল্যাব প্রচেষ্টায় যদি আমরা সফল হই, তাহলে আমরা দেশে বিশ্বমানের প্রযুক্তির ল্যাব তৈরির জন্য সরকারকে অনুরোধ করবো।’ খবর টিবিএস।

প্রকল্পের কো-ইনভেস্টিগেটর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরি জানান, ভেনম রিসার্চ সেন্টার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালে। অপর একটি প্রকল্পের আওতায় ভিআরসি-এর সংগ্রহ করা ভেনমের ল্যাব পরীক্ষার কাজ চলছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল ইমিউনাইজেশন ল্যাবে। এ গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে চন্দ্রবোড়ার অ্যান্টিভেনম ডিজাইনিং করা হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে আরও এক থেকে দেড় বছরের মতো সময় লাগবে। তিনি বলেন, অ্যান্টিভেনম ডিজাইনিং এর জন্য ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যালয়ের ল্যাবটি প্রস্তুত করা হয়েছে। সংগ্রহ করা হয়েছে কিছু প্রাণী। প্রাণীগুলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে লালন পালন করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো দেশে সাপের বিষনাশক ওষুধ উৎপাদনের প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালের মার্চ মাসে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে এই প্রকল্পের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চমেক মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও যুক্ত রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যাটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও বিশেষজ্ঞদল।

ভিআরসি-এর গবেষণা সহযোগী মোহাম্মদ নোমান জানান, বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন ১১ প্রজাতীর প্রায় ৩৫০টির বেশি সাপের বিষের সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ প্রজাতীর সাপের ক্যারেক্টারাইজেশনের কাজ শেষ হয়েছে; যা দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রথম।