কর্ণফুলী আমাদের জাতীয় সত্তার অংশ

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি »

কর্ণফুলীকে নিয়ে আমাদের চেতনা, ভাবনা, তাড়নার লেশমাত্র নেই। দেশের প্রধান অর্থকরী এই নদীর স্বাস্থ্য, গতিপ্রবাহ, সুস্থতা, দেহ প্রভৃতি আমাদের জাতীয় সম্পদ। জাতীয় সম্পদকে জাতীয়ভাবে সুরক্ষা দেয়া আমাদের দায়িত্ব। জাতীয় সম্পদের প্রতি নির্লিপ্ততা, অবহেলা, অমনোযোগিতা, অন্যায় নয় শুধু- পাপও বটে।
আমরা আমাদের এই প্রাণের স্পন্দনকে, জাতীয় সম্পদ, ঐতিহ্যের অংশকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্পদকে অবহেলা, অনাদরে, অব্যবস্থাপনায় নিঃশেষ করে চলেছি। তিলে তিলে, ধীরে ধীরে, দিনে দিনে, সময়ে অসময়ে। আমাদের আজকের এই নির্লিপ্ততার বলি হবে আগামী প্রজন্ম। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীর বিপন্নতা, বিপদাপন্নতা আজ আর অসাধারণ কোনো ঘটনা নয়। নিত্যনৈমিত্তিক সাধারণ ঘটনা। নদী বিপদাপন্ন। নদী বিড়ম্বিত। কর্ণফুলী আমাদের প্রাণের নদী। অস্তিত্বের নদী। অহংকারের নদী। সংস্কৃতির নদী। অর্থকরী নদী। অস্তিত্বের বিপন্নতা, ঐতিহ্যের মৃত্যু, সংস্কৃতির বিপদাপন্নতা কোন সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে পারে না। সংস্কৃতি সভ্যতার সোপান, এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যম, ঐতিহ্যের অংশীদার, সামাজিকতার উপাদান।
নদীকে বাদ দিয়ে আমরা অন্য মাত্রায়, অন্য ধান্দায়, অন্য মাধ্যমে, অন্য প্রক্রিয়ায় জীবনাচারে ব্যস্ত। এতে সামাজিকতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জীবনাচারের ধারাবাহিকতায় ছন্দপতন ঘটছে। চিরায়ত ঐতিহ্যকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। এটা শুধু অন্যায়ই নয়, আত্মার সাথে অত্যাচার, চিত্তের সাথে বিত্তের বেসাতি, হৃদস্পন্দনের সাথে লোভ ও লাভের ব্যবসা, ফুসফুসের সাথে প্রতারণা, রক্তপ্রবাহের ধমনীর সাথে মরণপণ যুদ্ধ, এটি অভিশাপ।
কর্ণফুলী একটি নদী। একটি ঐতিহ্য। একটি চলমান ইতিহাস। দূর অতীতকে নিকট অতীত হয়ে বর্তমানের সাথে মিশিয়েছে, মিলায়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ৩৪ ভাগ এই নদীর মাধ্যমে অর্জন। আমদানিÑরপ্তানির ৯০ভাগ সম্পাদিত হয় এই নদীকেন্দ্রিক বন্দরের মাধ্যমে।
এই নদীকেন্দ্রিক চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের সমৃদ্ধির সোপান। চট্টগ্রাম নদীবন্দরকেই আমরা বলি চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর। বর্তমানে বন্দরটি বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে ৫৮ তম। গত কয়েক বছরে বন্দরটি ১৬ ধাপ এগিয়েছে। লক্ষ্য বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আরো উপরে উঠে আসা।
এই যে দেশের সমৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি, অদম্য গতিতে এগিয়ে চলা, অর্থনীতির কথা বলা, দারিদ্রকে পিছনে ফেলা। প্রতিবেশী দেশসমূহকে ছাড়িয়েছে যাওয়ার প্রচেষ্টা, গড় আয় বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, সমৃদ্ধি, সবকিছুর সাথে এই নদীর সম্পৃক্ততা নিখুঁত-নিবিড়। ১৭ কোটি মানুষের বহরকে এগিয়ে নিয়ে অদম্য চলা, আমাদের অর্থকরী প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলীর প্রাণচাঞ্চল্যের সাথে চলার সাথে সম্পর্কিত। নিবিড় যুক্ত।
কর্ণফুলী নদী আমাদের অস্তিত্বের অংশ। নদীটি হাজার বছরের সংস্কৃতির নদী। এ অঞ্চলের সতেরটি নৃগোষ্ঠীর অবগাহনের প্রবাহ এই নদী। নদীটি আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সামাজিকতা, আমাদের পরিবেশ, আমাদের ঐতিহ্য। সামাজিক, পরিবেশগত, প্রাকৃতিক ঐতিহ্য দেশকে সমৃদ্ধ করে। অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। কোন জাতিগোষ্ঠীকে, জাতির সত্তাকে, অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করে তার শিকড়ের ঐতিহ্য।
সবার ঐতিহ্য সমান হয় না। ঐতিহ্যের স্বর্ণালী, বর্ণালী বোধ মানুষকে সামনের দিকে অদম্য গতিতে এগিয়ে নেয়। কথা বলে। পরিবর্তনের আবহ সংস্কৃতি, সামাজিকতা, অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়। আমরা চলি বিপরীত ¯্রােতে। ঐতিহ্যকে অহংকারের অংশ আমরা মনে করি না। ঐতিহ্যের শেষ অবশেষটুকু ধ্বংস করতে আমরা লিপ্ত থাকি। আমাদের এই মূর্খতা ঐতিহ্যের অনেক উপাদান, উৎস ধ্বংস হয়ে যেতে সুযোগ করে দিয়েছে। নদী ঐতিহ্য, পাহাড় ঐতিহ্য, সবুজের ঐতিহ্য, সমুদ্র ঐতিহ্য, হাওড় বাওর ঐতিহ্য, বিল ঝিল ঐতিহ্য, আমাদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ অতীত, সুখময় বর্তমান, বর্ণিল ভবিষ্যতের সম্পদ। এই সম্পদগুলোর প্রতি আন্তরিকতা, নিবেদন, মর্মের সংযোগ আমাদের অমূল্য সম্ভার।
হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশ। বৈচিত্র্যময় বিল-ঝিল হাওড় বাওরের দেশ বাংলাদেশ। আমাদের জাতিসত্তার সঙ্ঘবদ্ধ শক্তির স্লোগান নদী। ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’ অথবা ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’ কিংবা ওরে কর্ণফুলীরে, সাক্ষী রাখিলাম তোরে’ অথবা ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা’।
আমাদের ভূখ-ের ঐতিহ্যিক নামের সাথে বঙ্গোপসাগরের সম্পৃক্তি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের কর্ণফুলীর দুই পাড়ে, চারিধারে বৈপরীত্য কর্ণফুলীকে গিলে খেতে চায়। কর্ণফুলীর প্রবাহকে সংকুচিত করে, তার দেহকে লুট করার যে প্রক্রিয়া চালু আছে, তা দৃশ্যমান দেখেও আমাদের রক্তচাপ প্রভাবিত হয় না। প্রকারান্তরে এ রকম অপশক্তিকে আমরা উৎসাহিত করি।
এটি আমাদের মূর্খতা। এটি আমাদের অজ্ঞতা। কর্ণফুলীর প্রতি বিদ্বেষ, বিধ্বংসী, বুভুক্ষ আচরণ আমাদের অজ্ঞতা, মূর্খতা ও অজ্ঞানতার প্রবৃদ্ধি। এই নদীকে নিয়ে আমরা ব্যবসা করি। ব্যবসার মাধ্যমে থেকে ব্যবসার উপাদানে পরিণত করেছি আমরা নদীটিকে । এভাবে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের মূর্খতাকে ইতিহাসের উপাদানে পরিণত করছি। ড্রেজিং এর নামে নদীকে নিয়ে আমরা বেসাতি করি। বিজ্ঞ-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে আমরা ড্রেজিং ড্রেজিং খেলা করি। নদীর মূল্যবান মাটি পানি নিয়ে ব্যবসা করি। লাজহীন বেহায়ার কাজ করি।
দখলদার মুক্তির নামে আমরা চোর-পুলিশ খেলা করি। শিল্পের নামে আমরা নিয়মিতভাবে নদীটির ওপর অত্যাচার করি। এই দখলদার অত্যাচারীরাই আবার সমাজ, সামাজিকতা নিয়ন্ত্রণ করি। সরকারের সাথে মিশে থাকি। প্রশাসনকে প্রভাবিত করি। আমরা যারা প্রশাসক, তারা পেশাদার হতে পারিনি। অন্তত নদীটির প্রতি আমাদের আচরণ তাই বলে। আমরা যারা রাজনীতিবিদ, তারা নদীটির প্রতি সুবিচার করছি না। নির্লিপ্ততা প্রদর্শন করছি। সরকার ও জনগণের মাঝে বিশাল ফারাক তৈরি করছি। আমরা যারা শিল্পের মালিক, শিল্পপতি-তারা নদীটিকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছি। নদীটির প্রতি আচরণ আমাদের আর মানুষ রাখছে না। আমরা যারা নদীটির অংশীজন, তাদের অকৃতজ্ঞতা, নির্লিপ্ততা দুর্ভাগ্যজনক, দুঃখজনক। নদীটির অভিভাবক সৃষ্টি হয়েছে। একে জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আইন আইনের জায়গায় থেকেছে। নদীটির বিড়ম্বনা, দুঃখ-দুর্দশা থেমে থাকেনি। আইনের প্রয়োগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। নদীমাতৃক বাংলাদেশে এভাবেই নদী তার মাতৃত্বের পরিচয় হারিয়ে ফেলছে।
নদীটির ঐতিহ্য সাম্পান। সম্পান সংস্কৃতির সাথে এদেশের মানুষের সম্পর্ক হাজার বছরের। সাম্পান কর্ণফুলীর প্রাণ, অঙ্গ। কর্ণফুলী সাম্পানের সম্ভার, শোভা। পারস্পরিক এই সম্পর্ক ঐতিহ্যের, অহংকারের। সম্প্রতি কর্ণফুলী সাম্পান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। নদীর স্বাস্থ্য নিয়ে জনগণকে সচেতন করা, নদীর আত্মার সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করা, নদীর পাশে এসে দাঁড়ানো, নদীর সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা এই সাম্পান উৎসবের উদ্দেশ্য নদী ভ্রমণ করে জনগণকে সচেতন করার প্রয়াস নেয়া হয় সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন কর্তৃক।
আশা করা যায়, নদীটিকে নিয়ে দখল-দূষণ ড্রেজিংয়ের নামে প্রতারণার খেলা বন্ধ হবে। দীর্ঘদিন পর এরকম প্রচেষ্টা নদীটির অস্তিত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। নদীটির প্রতি দীর্ঘকালীন অবহেলার অবসান। দখলদারদের সতর্ক করা। রাজনীতি জনগণের জন্য। জনগণকে সাথে নিয়ে, জাতীয় সম্পদ সুরক্ষা দিয়ে, জনগণ ও দেশের সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশের মানুষকে সুশাসন এর মাধ্যমে, দেশপ্রেমের প্রকাশ দিয়ে স্বপ্নবান করার নামই রাজনীতি। আমাদের আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতিকে সে পথেই হাঁটতে হবে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আমাদের জাতীয় সম্পদগুলো, জাতীয় অহংকারের উপাদানগুলো, জাতীয় সমৃদ্ধির সোপানগুলো, সংস্কৃতি ও সামাজিকতার নিদর্শনগুলো সামাজিক, পরিবেশগত, আইনগত সুরক্ষা পাবে- এটাই সার্বজনীন কামনা হওয়া উচিত।
সকলে মিলে কর্ণফুলীর পাশে থাকলে এই নদীর দখল-দূষণ রোধ সম্ভব হবে এবং অন্যান্য বিপর্যয়গুলো ধীরে ধীরে অপসৃত হবে। এ প্রত্যাশা আমরা অন্তরে লালন করি। আসুন, প্রাণের নদী, অর্থকরী নদী, ঐতিহ্যের নদী, অহংকারের নদী কর্ণফুলীর পাশেই আমরা অবস্থান নিই।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক,
কর্ণফুলী গবেষক।