আগস্ট থেকে ৪০% শিপিং খরচ কমবে চট্টগ্রাম বন্দরে

কর্ণফুলী ড্রেজিং প্রকল্প

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বন্দরে ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার লম্বা জাহাজ ভিড়তে পারলে কনটেইনার ভলিউম দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এতে করে ১৫০০-২০০০ কনটেইনারের পরিবর্তে ২৫০০-৩০০০ কনটেইনারবাহী জাহাজ বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারবে। কর্ণফুলী ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসায় আগামী মাস থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। এতে করে শিপিং খরচ কমে আসবে ৪০ শতাংশ। খবর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর।

বর্তমানে, সর্বোচ্চ ৯.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারে। এসব জাহাজে একযোগে ১৫০০-২০০০ কনটেইনার বহন করা যায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ১১ বছর পর চট্টগ্রাম বন্দরের কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং প্রকল্পের ৯৩ শতাংশ কাজ হয়েছে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল বলেন, ‘বন্দরে ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার লম্বা জাহাজ ভিড়তে পারলে কনটেইনার ভলিউম দ্বিগুণ হয়ে যাবে।’

এতে করে ১৫০০-২০০০ কনটেইনারের পরিবর্তে ২৫০০-৩০০০ কনটেইনারবাহী জাহাজ বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

‘এর ফলে পরিবহন খরচ অনেক কমবে। ৪০ ফিটের কনটেইনারের পরিবহন খরচ ৮০০০ ডলার থেকে ৫০০০ হাজার ডলারে নেমে আসবে। আর ২০ ফিটের কনটেইনারের ব্যয় ৪০০০ ডলার থেকে ২৫০০ ডলারে নেমে আসবে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি ব্যয় কমবে,’ বলেন সৈয়দ ইকবাল।
বঙ্গোপসারের থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পণ্যবাহী জাহাজ কর্ণফুলী নদী হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ে। দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯০ শতাংশ এ বন্দরে হয়ে থাকে। বন্দরের জেটিসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব স্থাপনাই কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন বড় ধরনের ড্রেজিং না হওয়ায় এ নদীর তলদেশ প্লাস্টিক, পলিথিন ও পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে।

গভীরতা কমে যাওয়ায় বড় জাহাজগুলো কর্ণফুলী নদীতে প্রবেশ করতে পারে না। বহির্নোঙরে অবস্থান করে এসব লাইটার (অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের) জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করে। এছাড়া কিছু জাহাজ বহির্নোঙরে পণ্য কমিয়ে হালকা করার পর কর্ণফুলী নদী হয়ে বন্দরের জেটিতে নিয়ে আসা হয়।

কর্ণফুলী ড্রেজিং প্রকল্পের অধীনে, বন্দরসংলগ্ন প্রায় ৪ কিলোমিটার নদীর নাব্যতা ফেরাতে চীনের বিশেষায়িত ড্রেজার ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় ৪৬ ঘনমিটার বর্জ্য ও মাটি সরানো হয়েছে এ নদী থেকে।

চট্টগ্রাম বন্দরের কাজের গতি বাড়াতে ২০১১ সালে মালয়েশিয়ান মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন (এমএমডিসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি কাজ শেষ না করে চলে যাওয়ায় ২০ মাস মেয়াদী এই প্রকল্পটির চুক্তি ২০১৪ সালে বাতিল করা হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আইনি জটিলতায় ৫ বছর ঝুলে ছিল প্রকল্পটি।

২০১৮ সালে ‘কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট থেকে বাকলিয়া চর পর্যন্ত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্য বৃদ্ধি প্রকল্প’ নামে নতুন করে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
২০১৮ সালে নতুনভাবে নেওয়া প্রকল্পে কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় ৩.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং করে ৪২ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য উত্তোলনের কথা ছিল। কিন্তু নদীর তল দেশে ২-৭ মিটার পর্যন্ত প্লাস্টিক-পলিথিন, ময়লা-আবর্জনার স্তুপ থাকায় ড্রেজার কাজ করছিল না। এজন্য ৩৯ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর প্রকল্পটির ব্যয় ৬৩ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৩২১ কোটি টাকা চূড়ান্ত করা হয়। তখন ৫১ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়। এরপরও পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েছে কাজ।

নগরীতে এখনো পূর্ণাঙ্গ ও কেন্দ্রীয় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের এই শহরে দৈনিক প্রায় ৪০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য এবং ৩ লাখ লিটার গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপন্ন হয়। নালা থেকে ৫১টি খাল হয়ে বর্জ্য যায় কর্ণফুলীতে। এছাড়া কয়েকশ টন শিল্প কারখানার বর্জ্যসহ সব ধরনের ময়লা-আবর্জনাও যায় এই নদীতে। আর বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সাথে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টন পলি গিয়ে পড়ে এই নদীতে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেকের সিস্টার কনসার্ন ই-ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ করেছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটির প্রজেক্ট ম্যানেজার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই আবর্জনার স্তরের কারণে কাজ করতে অনেক সময় লেগেছে। প্রথমে গ্রাফট ড্রেজার দিয়ে ময়লার স্তুপ সরানো হয়। এরপর বাল্ক কেরিয়ারের মাধ্যমে এসব আবর্জনা কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহার বোয়ালখালী এলাকায় ডাম্পিং করা হয়। এ কাজে ২০-২৫টি বাল্ক কেরিয়ার এবং ১০টিরও বেশি গ্রাফট ড্রেজার ব্যবহার করা হয়েছে। বর্জ্যের স্তুপ সরানোর পর ওই স্থানে ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন করা হয়েছে।’
মাটি ফেলা হয়েছে বাকলিয়ারচর, বাকলিয়া থানার পেছনে, বাস্তুহারা, ফিরিঙ্গিবাজার, চাক্তাইখালের সামনে, শাহআমানত সেতুর উত্তরপাশে ছাড়াও আরো কিছু সংরক্ষিত স্থানে।

সাইফুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল-নদীর পলি মাটি। ড্রেজিং করে মাটি উত্তোলনের পর আশপাশ থেকে মাটি পড়ে আবার স্থানটি ভরাট হয়ে যেত। এ কারণে একই স্থানে কয়েক বার ড্রেজিং করতে হয়েছে। প্রায় ৪৬ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য অপসারণের কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত নিয়মিৎ রক্ষণাবেক্ষণের অংশ হিসেবে ড্রেজিং চলবে। যেখানে জাহাজ চলাচলে বাধা সৃষ্টি হবে সেখানে ড্রেজিং করা হবে।’

ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান বলেন, ‘বুয়েটের পরামর্শকদের কথা মতো প্রথমে আমরা কোথায় কী পরিমাণ ময়লার স্তুপ আছে, তা নির্ণয় করেছিলাম। এক্ষেত্রে জাহাজের ইকো ফাউন্ডার যন্ত্রের মাধ্যমে এবং পাইপলাইন বসিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহের মাধ্যমে ময়লার গভীরতা নির্ণয় করা হয়। গ্রাফট ড্রেজারের মাধ্যমে উপরের ময়লার লেয়ার সরিয়ে এরপর মাটি উত্তোলন করা হয়।’

তিনি জানান, মোট ৫১ লাখ ঘনমিটার বর্জ্যের মধ্যে ২৫-২৭ লাখ হাজার ঘনমিটারই প্লাস্টিক, পলিথিন, রাবারসহ শক্ত বর্জ্য ছিল। চাক্তাই-রাজাখালী খালের সামনের অংশ থেকে উত্তোলন করা ৮৫-৯০ শতাংশ গার্বেজ বর্জ্য। বাকি অংশে ৬০-৬৫ শতাংশ এই বর্জ্য ছিল। আবার কর্ণফুলী ব্রিজের দিকে এই ধরনের বর্জ্য কিছুটা কম ছিল।

ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ এই মাসেই শেষ হয়ে যাবে। এরপর ২০২৫ সাল পর্যন্ত মেইন্টেন্যান্স ড্রেজিংয়ের কাজ চলবে বলে জানান তিনি।
এদিকে কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং প্রকল্পের কারণে তলদেশের ধীরগতির প্রাণী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ড্রেজিংয়ের সময় কেচো প্রজাতি এবং শামুক-ঝিনুক প্রজাতির ধীর গতির প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ড্রেজিংয়ের কারণে প্রাণীদের অনুকূল পরিবেশও ব্যাহত হয়।’

কর্ণফুলী নদীতে বিপন্ন ডলফিন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এদের চলাচলের রুট রয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। কিন্তু তাদের পরিবেশের প্রতিও নজর দেওয়া উচিত। আমরা কিছু প্রস্তাবনাও দিয়েছি। বিভিন্ন চ্যানেলের মুখগুলো উন্মুক্ত রাখতে বলেছি। কারণ এখান থেকে ডলফিন খাবার সংগ্রহ করে।’

চট্টগ্রাম বন্দর নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) এবং জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) নামে ৩টি টার্মিনাল রয়েছে। এর মধ্যে এনসিটি এবং সিসিটিতে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ যাবে। এছাড়াও বন্দরে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এই টার্মিনালে চারটি বার্থ রয়েছে।