রতন কুমার তুরী »
বেশ জমে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারণা। ক্রমেই কলকাতা যেনো মিছিলের নগরীতে পরিণত হচ্ছে। কলকাতার বিভিন্ন জনপদে খবর এখন একটাই, এবার কার দখলে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। তৃণমূল ? বাম- কংগ্রেস? নাকি বিজেপি ? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এবারের বিধানসভা নির্বাচনে সব দলই কোমর বেঁধে নেমেছে। ইতিমধ্যে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস বেশ বড়সড় সমাবেশ করে নির্বাচনে তাদের শক্ত অবস্থানের প্রমাণ দিয়েছে। এদিকে নির্বাচনের সব খবর ছাপিয়ে বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। সাম্প্রতিক তিনি কলকাতায় বাম জোট কংগ্রেসের ব্রিগেড সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছেন। মুসলিমদের এই জনপ্রিয় নেতা আব্বাস সিদ্দিকীর দলের নাম হচ্ছে “ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট” সংক্ষেপে ‘আইএসএফ’। বাম-কংগ্রেসে যোগ দিয়েই সেদিন আব্বাস সিদ্দিকী তার ভক্ত সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ভাষণও দিয়েছিলেন। আব্বাস সিদ্দিকীর এই ভাষণের পরপরই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মাঠে চলছে নানা জল্পনাকল্পনা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এবার পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩০ ভাগ মুসলিম ভোটার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে। প্রকৃতপক্ষে গত এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা তৃণমূলের অন্যতম মূল শক্তি ছিল মুসলিম ভোটার। এ বছর মুসলিমদের জনপ্রিয় নেতা আব্বাস সিদ্দিকী নির্বাচনে নামায় মুসলিম ভোট ব্যাংকের অনেকটাই মমতার হাতছাড়া হতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।
এই ৩০ ভাগ মুসলিম, যারা কখনোই বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় চায় না, তাদের ভোট বিবেচনা করলেও ক্ষমতায় আসার মতো বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের বিপুল ভোটার নেই। তবে এসব ভোটার যদি আব্বাস সিদ্দিকীকে ভোট প্রদান করে তবে তৃণমূলের ভোটব্যাংকে ধস নামতে পারে।
আর এই মুসলিম ভোট যদি ভাগ হয়ে যায় তাহলে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ এমন কি এই ভাগাভাগিতে বিজেপি এই নির্বাচনে জিতে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এখন প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে কেনো ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী বাম-কংগ্রেসে যোগ দিলেন। প্রকৃতপক্ষে টানা দুই মেয়াদে নির্বাচনে জিতে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আছেন মমতা, এর আগে টানা ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট কিন্তু তারা সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য কিছুই করেনি বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জি মুসলিমদের ভোট নিয়ে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আসলেও তিনিও কথা রাখেননি, ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আব্বাস সিদ্দিকী নির্বাচনী নাঠে নেমেছেন বলে নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন। আব্বাস সিদ্দিকীর মতে, ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেও বামফ্রন্ট রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন কিছু করেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল তৃণমূল মুসলিমদের উন্নয়নের কথা বলে ক্ষমতায় এলেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। আব্বাস সিদ্দিকী মনে করেন, ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে মুসলিমদের নিজেদেরই রাজনীতিতে আসতে হবে। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য কিছু না করার জন্য মমতা সরকারকে সরাসরি সমালোচনা করছেন আব্বাস সিদ্দিকী ।
সাম্প্রতিক ব্রিগেড সমাবেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, এই বাংলা ব্রিটিশদের মতো কালো হাত ভেঙে দিয়েছে। বাংলা থেকে বিজেপি, তৃণমূলকে ছাঁটাই করে ছাড়ব। আমরা বাংলা বাঁচাব। গণতন্ত্র বাঁচাব। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান দেবো, প্রত্যেকের পেটে ভাত দেবো।’ তৃণমূল ও বিজেপি উভয় দলকেই হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘পিছিয়েপড়া দলিত, আদিবাসী, মুসলিম সবার জন্য আমি, আব্বাস সিদ্দিকী আছি।’ ‘আমরা ভারতীয়, আমরা গর্বিত, ভিক্ষা নয়, অধিকার চাই’, স্লোগানে তিনি জনতাকে মাতিয়ে রাখেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের কয়েকটি ভিডিওতে আব্বাস সিদ্দিকীর ভাষণে কয়েক হাজার সমর্থকদের ব্যাপক উল্লাস দেখা গেছে। এই সমস্ত ভিডিও শেয়ারও হয়েছে ব্যাপক ফলে মমতা’র তৃণমূল এই এ মুহূর্তে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস আব্বাস সিদ্দিকীর দলের কিছু কাছের মানুষকে তাদের দলে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে। অন্যদিকে কংগ্রেসপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ আব্বাস সিদ্দিকীর দলের সাথে কংগ্রেসের জোট গঠনের বিষয়টি ভালো চোখে দেখছে না, তারা বলছে কোনো সাম্প্রদায়িক দলের সাথে কংগ্রেসের জোট গঠন তাদের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী। এ বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির মি.আনন্দ শর্মা আইএসএফ কিংবা এ ধরনের দলগুলোর সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ‘দলের মূল আদর্শের পরিপন্থি’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘গান্ধী ও নেহেরুর কংগ্রেসের প্রাণ “ধর্মনিরপেক্ষতা”। আমাদের অবশ্যই সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।’
অন্যদিকে, ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টে কেবল মুসলিম নয়, দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের নেতাও আছেন উল্লেখ করে বাম নেতারা আইএসএফ সাম্প্রদায়িক শক্তি নয় বলে দাবি করে এসেছেন।
প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, উত্তর চব্বিশ পরগণা, হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান এবং বীরভূমের মতো দক্ষিণের জেলাগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয় ফুরফুরা শরীফের শাহজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন তার পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও তিনি নিজে দাঁড়াবেন না। পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে কে সরকার গঠন করবে তা বলা না গেলেও পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু ব্যাপক মুসলিম ভোটারের ভোট যদি আব্বাস সিদ্দিকীর দলে পড়ে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে উপলক্ষ করে নতুন মেরুকরণ ঘটতে পারে, যা সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক