নিজস্ব প্রতিবেদক, রাঙামাটি »
‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রত্যেকটি জেলা কমিটির মেয়াদ ১ বছর। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা শাখার বার্ষিক সম্মেলন হয়েছে ২০১৫ সালের ২ জুন (সোহাগ ভাই/নাজমুল ভাইয়ের পরিষদ দায়িত্বে থাকাকালীন) আজকের দিনসহ হিসাব করলে রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের বয়স/মেয়াদ চলছে ৭ বছর ৩ মাস ১৭ দিন। এ মেয়াদ/বয়স বিগত সকল কমিটিকে ছাড়িয়ে গেছে! (রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের ইতিহাসে)। সুতরাং বর্তমান পরিষদের দীর্ঘ এ পথচলার সময়টা যেন অতিশিগগিরই পরিসমাপ্তি ঘটে সেই আবেদন প্রার্থনা করছি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নিকট। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা শাখার বার্ষিক সম্মেলন শেষ করার মধ্যদিয়ে নিয়মিত ছাত্রদের হাতে/তরুণ প্রজন্মের হাতে শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির পতাকা তুলে দেওয়া হোক। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
৭ বছর পরও সম্মেলন না হওয়ায় রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ চাকমার ফেসবুক স্ট্যাটাস এটি (১৯ সেপ্টেম্বর, যেটি নিজের ওয়ালে পোস্ট করেন তিনি)।
এই স্ট্যাটাসের নিচে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক, বর্তমান ও পদপ্রত্যাশী অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীই সম্মেলন না হওয়ার আক্ষেপের কথা লিখেছেন। এর দুইদিন পরই প্রকাশ চাকমা ফেসবুকে ১৪ অক্টোবর সম্ভাব্য জেলা সম্মেলনের কথা জানিয়েছিলেন।
তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ১৩, ১৪ এবং ১৫ অক্টোবর যথাক্রমে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির জেলা সম্মেলনের কথা আনঅফিসিয়ালি জানিয়েছেন, অফিসিয়ালি শিগগিরই জানাবে।
তবে সর্বশেষ খবর হলো, প্রকাশ চাকমাদের আশা আরো একবার মিইয়ে গেলো অজানা কারণে। ১৩ অক্টোবর বান্দরবান ছাত্রলীগের সম্মেলন হচ্ছে ঠিকই, খাগড়াছড়িরটাও তারিখ জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র, কিন্তু রাঙামাটির সম্মেলনের খবর নাই! কিন্তু কেনো? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো আজব সব তথ্য। খোদ সভাপতিই চাননা সম্মেলন। তিনিই বলছেন, ‘সম্মেলন করার মত পরিবেশ নাই’।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে জেলা সম্মেলনের পর কাউন্সিল ছাড়াই কেন্দ্রঘোষিত সুজন-প্রকাশ কমিটি ইতোমধ্যেই আট বছরে পা দিয়েছে। কমিটি ঘোষণার পর দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরের পর সভাপতির নানা বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে বারবার আলোচনায় আসা ছাড়া এই কমিটির অর্জন বলতে কিছুই নেই। বরং এদের সময়েই রাঙামাটি সরকারি কলেজে দুই গ্রুপের মারামারির পর গত চারবছর ধরে স্থগিত ছাত্রলীগের কর্মকা-, নেই কলেজ কমিটিও। গত আট বছরেও করতে পারেনি রাঙামাটি মেডিক্যাল কলেজ কমিটি। দশ উপজেলার বেশিরভাগ কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ, অনেকেই যুবলীগ-আওয়ামী লীসহ বিভিন্ন সংগঠনে চলে গেলেও খালি পড়ে আছে ছাত্রলীগের পদ। জেলা ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল পদের অধিকাংশ নেতাই বিয়ে করে সংসারি হয়েছে, অনেকেই সন্তানের পিতাও। সরকারি চাকরি কিংবা উচ্চ শিক্ষার জন্য রাজনীতির বাইরে চলে গেছে অনেকেই। পুরো জেলায় দৃশ্যত স্থবির ছাত্রলীগের কর্মকা-। বহুদাবিভক্ত এই সংগঠনটি নিয়ে বিরক্ত ও বিব্রত রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাও।
রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ চাকমা বলেন, ‘সম্মেলন তো আমি নিজেই চাই। নিজেকে ছাত্রলীগে নেতা পরিচয় দিতে এখন লজ্জা লাগে। এক বছরের কমিটি এখন আট বছর চলছে। সম্মেলন চাই বলেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছি। কেন্দ্রের সাথে আমি বহুবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা তারিখ দিবে বলে আর দেয়না। কি কারণে দেয়না জানিনা। তবে নেতাকর্মীরা সম্মেলন চায়। অনেকের বয়স পার হয়ে গেছে, যাচ্ছে। অনেকের রাজনৈতিক জীবন নষ্ট হচ্ছে। এর দায় এড়াতে পারিনা।’
এদিকে রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল জব্বার সুজন বললেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের গঠনতান্ত্রিক নিয়মে আগে বিভিন্ন উপজেলা ও অধস্থন ইউনিটের সম্মেলন হতে হবে, তারপর জেলা সম্মেলন। সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে কেউ গায়ের জোরে সম্মেলন চাইলে তো সম্মেলন হবেনা।’ আপনি সম্মেলন চান কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সুজন বলেন, ‘এটা আমার চাওয়ার বিষয় নয়। কেন্দ্র যেভাবে নির্দেশনা দিবে সেভাবে সব হবে। তবে এখন সম্মেলন করার পরিবেশ-পরিস্থিতি নাই।’ কেনো পরিবেশ পরিস্থিতি নাই, এমন প্রশ্নের জবাবে সুজন বলেন, ‘আমার বিভিন্ন ইউনিটের কমিটির মধ্যে অনেকগুলোর বয়স আমাদের চেয়েও বেশি। আমার সেক্রেটারি প্রকাশ চাকমা আমাকে সহযোগিতা না করায় পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যার কারণে কমিটি করতে পারিনি। সেইসব কমিটিগুলো না করে তো সম্মেলন হতে পারেনা।’ তাহলে যদি বিগত সাত বছরের মত আগামী আরো সাত বছর লাগে পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হতে তাহলে কি করবেন ? এমন প্রশ্নের জবাবে সুজন বলেন, ‘যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। আমার কি করার আছে।’
তবে সভাপতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে প্রকাশ চাকমা বলেন, ‘সে আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করছে তা সত্য নয়। আমাদের ছয়টি ইউনিটের সম্মেলন বাকি আছে। জেলা সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হলে এই ছয়টি সম্মেলন করতে ছয়দিন লাগবে। সে আসলে টালবাহানা করে সম্মেলন আটকাতে চাইছে।’
তবে রাঙামাটি জেলার সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক আল আমিন সুজন জানান, আমার সাথে সাধারণ সম্পাদকের বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে সাংগঠনিক নানা বিষয়সহ সম্মেলনের বিষয়েও, সে বলেছে সম্মেলন চায়। সভাপতি যে সম্মেলন চায়না এটাতো আমিও বুঝিনি। সে অসুস্থতা ও ভারতে চিকিৎসা নেয়ার বিষয় বলেছিলো এতদিন। এখন তো সম্মেলন না হওয়ার কোন পরিস্থিতি নাই। আমি বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রে কথা বলব। ইতোমধ্যেই সাত বছর পার হয়ে গেছে। এখন আর তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছায় নয়, কর্মীদের প্রত্যাশা এবং কেন্দ্রের সিদ্ধান্তেই সম্মেলন হবে।’
জেলা ছাত্রলীগের গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক হাসান মুরাদ বলেন, ‘রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সুনজর চাই আমরা! আমরা তাদের প্রতি অনুরোধ জানাতে চাই, নতুন নেতৃত্ব না আসার কারণে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের অনেক নেতাকর্মীর স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে একটি সংগঠন চলতে পারেনা।’
জেলা ছাত্রলীগের স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক তারেক হোসেন মাহিম বলেন, ‘আমরা সম্মেলন চাই। সম্মেলন না হওয়ার কারণে আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। এক বছরের কমিটি এখন আট বছর চলছে, এটার দায় তো দায়িত্বশীলদের নিতে হবে। খাগড়াছড়িতে আহ্বায়ক কমিটি হয়েছিলো, এখন সম্মেলন হচ্ছে, বান্দরবানও হচ্ছে। আমাদেরটা কেনো হচ্ছেনা জানিনা। সম্মেলন না হওয়ার কারণে ছাত্রলীগ স্থবির হয়ে গেছে।’
জেলা ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ইকবাল আহমেদ তালুকদার রিজওয়ান বলেন, ‘সংগঠন দৃশ্যত ধ্বংস হয়ে গেছে এই জেলায়। কোথাও কোন কমিটির মেয়াদ নাই। পুরো একটা প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ছাত্রলীগকে পুনরায় গড়ে তুলতে অনেক কষ্ট হবে।’
বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কাউছার সোহেল জানান, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুসারে ১৩ অক্টোবর বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাঙামাটি জেলারটা কেনো হচ্ছেনা জানিনা। এটা কেন্দ্রীয় নেতারা বলতে পারবেন।’
খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক উবিক মোহন ত্রিপুরা জানালেন, ‘১৩ তারিখ বান্দরবানের সম্মেলন হচ্ছে, ১৪ অক্টোবর জেলা সম্মেলন করার জন্য কেন্দ্র থেকে বলেছে। আমরা বলেছি, যেহেতু রাঙামাটিরটা হচ্ছেনা, তাই রাঙামাটিরটা যখন হবে আমাদেরটারও তখন তারিখ দিতে। কারণ এখন দুর্গাপূজা ও আমাদের আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি অসুস্থ।’
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর জানান, ‘জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনের জন্য আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার বলেছি। সেও সম্মেলন দিতে চায়। কিন্তু ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় রাঙামাটির সম্মেলনের তারিখ দিচ্ছেনা। যতটুকু শুনেছি কার যেনো একজন মায়ের অনুরোধে বা নির্র্দেশে রাঙামাটির সম্মেলনের তারিখ দেয়া হচ্ছে না। এটা নিয়ে আমরাও বিব্রত। বিষয়টি আমার চিঠি দিয়ে নেত্রীকে জানিয়েছি। দাদাও (দীপংকর তালুকদার) বিষয়টি দেখছেন। দেখা যাক কি হয়। তবে রাঙামাটিতে ছাত্রলীগ বলতে গেলে ধ্বংসই হয়ে গেছে।’