চড়া দামে বিক্রির অভিযোগ
ব্যবসায়ীদের ধর্মঘট প্রত্যাহার
রাজিব শর্মা
শনিবার সকালে পাহাড়তলী ডিম ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা বন্ধ ঘোষণা শোনার সাথে সাথে রাতের মধ্যেই নগরীর বাজারগুলোতে ডিম উধাও। এতে বাজারে ডিম কিনতে আসা ক্রেতাসহ সাধারণ মানুষ চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা সিন্ডিকেটের কারসাজি ও সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেন।
ক্রেতারা অভিযোগ করে বলেন, ডিমের সংকট দাবি করে প্রায় দোকানে ব্যবসায়ীরা অল্প ডিম রেখে বিক্রি করছে চড়া দামে। কারসাজি করে ডিমের বাজারকে আবারো অস্থির করার চেষ্টা করছে বলে জানান ভোক্তারা।
এদিকে শনিবার থেকে ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছিলেন পাহাড়তলী বাজারের ডিম ব্যবসায়ীরা। ৩৬ ঘণ্টা পর রোববার বিকাল ৫টায় তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন।
জানা গেছে, বাজারে দুই সপ্তাহ আগে ডিমের দাম কমতির দিকে ছিল। পর্যাপ্ত যোগান ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো থাকার পরও ব্যবসায়ীরা ‘কৃত্রিম সংকট’ দেখিয়ে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা বিক্রি করেন। এ কারণে ভোক্তা অধিকার ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়তলীতে চারটি অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদেরকে জরিমানা করা হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ হয়ে শনিবার সকাল থেকে ডিম বেচাকেনা বন্ধ রাখেন। ফলে প্রত্যেক ডিমের বাজারে সংকটের প্রভাব দেখিয়ে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে গতকাল রোববার নগরীর ৫টি বাজারে গিয়ে ক্রেতাদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
রেয়াজউদ্দিন বাজার ও বকসিরহাট ডিমের আড়ত সরেজমিনে দেখা যায়, যে দোকানগুলোতে দুইদিন আগেও আড়ত ভর্তি ডিম দেখা গিয়েছিল তা গতকাল একদম খালি। বলা যায়, প্রায় দোকানের আড়তে ডিম নেই। তার মধ্যে গত একদিনের ব্যবধানে ডজনপ্রতি ফার্মের মুরগি, দেশি ও হাঁসের ডিমের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। বাজারে লেয়ার (লাল) মুরগির ডিম বিক্রি হয়েছে ডজনপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। আর দেশি মুরগির ও হাঁসের ডিম বিক্রি হয়েছে ডজনপ্রতি ২২৫ থেকে ২৩০ টাকা। সে হিসেবে এক রাতের ব্যবধানে খুচরা বাজারে ডিম বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস ১৫-১৬ টাকা দরে। এতে তারা চরম বিপাকে পড়েন বাজারে আসা ক্রেতারা।
সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য সদরঘাটের আলকরণ এলাকা থেকে রেয়াজউদ্দিন বাজারে ডিম কিনতে আসা ফরিদুল আলম বলেন, ‘সোমবার আমার পরিবারে একটি অনুষ্ঠান আছে। মাংসের দাম বাড়ায় চেয়েছিলাম খাবারের মেন্যুতে ডিম রাখবো। কিন্তু বাজারে এসে দেখি কোথাও ডিম নেই। কয়েকজন ডিমের বিক্রেতার ব্রোকার এসে বললো ডিম দেওয়া যাবে তবে তা কিনতে হবে ১৭০ টাকার উপরে। ১২০ টাকার ডিম ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৭০ টাকা বিক্রি করা মানে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটরা পুরো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে।’
বকসিরহাটের বাজারে ডিম কিনতে আসা আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘এখানে সব দোকানে খালি দেখা যাচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছে ডিমের ডজন ১৭৫ টাকা লাগবে। এত দামে কেনা ডিম কেনা সম্ভব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে কেন ডিমের দাম চড়া তার কোন উত্তর আমাদেরকে ব্যবসায়ীরা বলছে না। শুধু বলছে, দোকানে ডিম নেই। ব্যবস্থা করে এনে দেওয়া যাবে। যদি নিতে চান ১৭৫ টাকায় ডজন নিতে হবে।
চকবাজার কাঁচাবাজারে ডিম কিনতে আসা আরিফুর রহমান বলেন, ‘গতকালও ডিম দেখছ্ িকিন্তু ব্যবসায়ীরা ডিম সরিয়ে বাজার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারকে অস্থির করার চেষ্টা করছে। ব্যবসায়ীদের এসব বিষয়ে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। না হয় সাধারণ মানুষ তাদের কাছে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে যাবে।’
সিরাজউদদোল্লা রোড সাবেরিয়া বাজারে ডিম কিনতে আসলে মো. আলমগীর নামের এক প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বলেন, ‘চাল-ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্য কিনে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। গরিবের খাদ্য ডিমের বাজারও গরম। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সব কিছুর দামই বাড়ছে। গরিব মানুষ কিভাবে বাঁচবে?’
এদিকে নগরীতে ‘ডিম উধাও’ ও ‘দাম চড়া’ কেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে যার প্রকৃত কারণ বলতে পারছে না নগরীর ডিমের বাজারের ব্যবসায়ীরা। একেক ব্যবসায়ী তাদের মনগড়া কথা বলেছে।
রেয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী মো. হারুন বলেন, ‘আমরা ডিম বিক্রি করছি না। ক্রেতারা যা অভিযোগ তুলছে তা মিথ্যে। মূলত পাইকারি আড়ত পাহাড়তলী বাজারে ডিম বেচাকেনা বন্ধের কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে কেউ কেউ ডিম বাড়তি দামে বিক্রি করছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বকসিরহাটের একজন ডিম ব্যবসায়ী বলেন, ‘বাজারে কোথাও ডিম নেই। ফলে ডিম কিনতে পারিনি। তাই বিক্রি করতে পারছি না। কিছু ডিম আমরা বিভিন্নভাবে কিনেছি। যা কেনা পড়ছে ১ হাজার ৩০০ টাকার উপরে। এজন্য ১৭০ টাকা ডজন বিক্রি করতে হচ্ছে।’
এদিকে জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকারের অভিযানের ফলে ‘হয়রানি’ দাবি করে শনিবার থেকে বন্ধ রেখেছিলেন পাহাড়তলী বাজারের ডিম ব্যবসায়ীরা। যার ৩৬ ঘণ্টা পর রোববার বিকাল ৫টায় তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল শুক্কুর।
তিনি বলেন, ‘আজ (রোববার) বিকালে আমাদেরকে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে সার্কিট হাউজে ডাকা হয়েছে। তারা আমাদেরকে বলেছেন, আমরা যেন ক্রয়মূল্যের বিল, ভাউচার ও মেমো রাখি। আর ধর্মঘট প্রত্যাহার করি। প্রশাসনের নির্দেশ আমরা প্রত্যাহার করেছি।
রোববার নগরীর বাজারগুলোতে হঠাৎ ডিমের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নগরীর যত ডিম ব্যবসায়ী আছে তারা আমাদের থেকে ডিম কিনে নিয়ে যায়। আজকে (রোববার) নগরীর ব্যবসায়ীরা যা করছে তা সম্পূর্ণ কারসাজি। অসাধু ব্যবসায়ীরা ডিমের দাম বাড়াচ্ছে। গত দুইদিন ধরে পাহাড়তলীতে কোন ডিমই বিক্রি হয়নি। আমরা ডিম না কেনাতেই উত্তরবঙ্গের বাজারে প্রতি পিস ডিম ৭০ পয়সা কমেছে। তাহলে তারা আজকে এত চড়া দামে ডিম কিনলো কোথায় থেকে? এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান পরিচালিত হোক।
এদিকে ডিম ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠকের বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসন কর্মকর্তা প্লাবন বিশ্বাসকে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে শীঘ্রই বাজারে অভিযান পরিচালনা করবেন বলে জানান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটির বিভাগীয় উপপরিচালক মো. ফয়েজ উল্যাহ বলেন, আমরা আরো কয়েকদিন বাজার বিশ্লেষণ করি, তারপর সিদ্ধান্ত নেব।