শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দাকে হার মানিয়ে পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প শেষ করেছে সরকার। স্বপ্নের সীমানা পেরিয়ে ১০০ কিলোমিটারের রেলপথ নির্মাণসহ নয়টি রেলস্টেশন গড়ে তোলা হয়েছে এ প্রকল্পে।
আজ (শনিবার) রেলপথটির উদ্বোধন করার পর ১ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে রেল চলাচল শুরু হওয়ার কথা জানিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়। এতে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো আরও শক্তিশালী হবে বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, ২০১০ সালের ৬ জুলাই সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিতে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি গ্রহণ করে। শুরুতে সিঙ্গেল লাইনে মিটারগেজে রেলপথের নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর একনেকের এক সভায় রেলপথটি ডুয়াল গেজ নির্মাণের নির্দেশনা দিয়ে ২০১৬ সালের প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।
এরমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং ৬ হাজার ৩৪ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
সব নিশ্চিত করে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ না হলেও চলতি বছরের ৫ নভেম্বর (রোববার) সকাল ৯ টার দিকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রথমবারের মতো পর্যটন নগরী কক্সবাজারের উদ্দেশ্য একটি পরীক্ষামূলক রেলগাড়ি ছেড়ে যায়। পরীক্ষায় রেলপথটি অনুমতি পাওয়ার পর ৭ নভেম্বর (মঙ্গলবার) দুপুর ২টা ২০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী রেলগাড়িটি অতিরিক্ত চারটি বগিসহ ১৯টি বগি নিয়ে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন ত্যাগ করে।
রেল কর্মকতারা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার প্রকল্পের সহায়ক হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগে নতুন সংযোজন হয়েছে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ। এ প্রকল্পে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ ও আন্ডারপাসসহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে প্রতিবন্ধকতা ছিলো দুই জায়গায়। একটি হলো- আগস্টের অতিবৃষ্টিতে সাতকানিয়া ও বান্দরবান সংলগ্ন তেমুহনী এলাকায় আধা কিলোমিটারের রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যটি হলো- কালুরঘাট সেতুর সংস্কারকাজে দেরি হওয়া।
প্রতিবন্ধকতা সমাধানে রেলওয়ে
আগস্টের বৃষ্টিতে রেলপথের ক্ষয়ক্ষতি সারাতে খুব বেশি সময় নেয়নি পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে। দীর্ঘদিনের লাখো মানুষের দাবিতে ৯৩ বছরের এ রেলসেতুটি নতুন করে নির্মাণ না করে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞার নেতৃত্বে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শে সেতুরটির কাজ শুরু হয় চলতি বছরের ১ আগস্ট থেকে।
সংস্কারকাজ প্রসঙ্গে মো. আবু জাফর মিঞা বলেন, ‘কালুরঘাট সেতুর সংস্কারকাজ বলতে আমরা এখন রেলপথের কাজটা শেষ করেছি। এরজন্য বেইজমেন্টের স্থায়িত্ব বাড়ানো হয়েছে। এখন ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ বাকি রয়েছে।’
সেতু সংস্কারের বুয়েট টিম কতটুকু সন্তোষ প্রকাশ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২ আগস্ট বুয়েট টিম পরিদর্শনে আসে। তখন তারা সামান্য কিছু ত্রুটি দেখিয়েছে। কোনো সমস্যা হয়নি। এরপরও ওনারা যে সমস্যাগুলো দেখিয়েছেন, সেগুলো আমরা একদিনের মধ্যে ঠিক করেছি। সব ঠিকঠাক থাকা স্বাপেক্ষে ৪ আগস্ট এ সেতুর ওপর দিয়ে তিনটি ভারি ইঞ্জিন চালানো হয়। পরবর্তীতে এ সেতুর ওপর দিয়ে কক্সবাজার রেলপথের পরিদর্শক দল এবং পরে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী ট্রেন যায়।’
সেতুর ওপর রেল চলাচলের গতিসীমা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক অবস্থায় সবগুলো ট্রেন ১০ কিলোমিটার গতিতে গেছে। উদ্বোধনের পর আরও কিছু কাজ হবে তারপর ওয়াকওয়ে করা হবে। তখন গতি আরও বাড়বে। আমরা চাচ্ছি, ৫০-৬০ কিলোমিটার গতিসীমা উপযোগী করতে। কিন্তু পুরোনো স্ট্র্যাকচার, তাই চাইলেও অতোটা করা হয়তো সম্ভব হবে না। তবে ৩০ কিলোমিটার গতি উপযোগী হবে।’
দোহাজারী-কক্সবাজারের নতুন রেলপথ
আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি চট্টগ্রাম থেকে ষোলশহর লাইন নির্মাণ করে ১৯২৯ সালে। ১৯৩১ সালে ষোলশহর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করে। এর প্রায় ৯২ বছর পর নির্মিত হয় দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ। এ রেলপথটির প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রকৌশলী মোহাম্মদ মফিজুর রহমান। বর্তমানে এই রুটে ডুয়েলগেজের প্রকল্প পরিচালনা করছেন প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন।
রেলপথ নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, ‘এ প্রকল্পের আওতায় ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, বিভিন্ন শ্রেণির ৯৬টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে। হাতি চলাচলের কথা ভেবে রেলপথে একটি আন্ডারপাস ও ওভারপাসও করা হয়েছে। এছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি স্টেশন। এরমধ্যে ৬টির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে।’
এ রুটের ডুয়েলগেজপ্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, ‘আমি তো এর আগে আখাউড়া থেকে লাকসাম ডুয়েলগেজ প্রকল্প শেষ করেছি। একইভাবে এখানের প্রকল্পটি শেষ করবো। এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো।’
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘কক্সবাজার পুরো দেশের একটি বিশেষ আকর্ষণ। পর্যটনের কারণে কক্সবাজারের বিকল্প কিছু ভাবা যায় না। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটবে। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকরা সবুজে ঘেরা বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে এই রেল যাত্রাকে খুব উপভোগ করবে। এতে দেশের আয় বাড়বে। যাত্রীবাহী ট্রেন ছাড়াও পণ্যবাহী ট্রেন চালু হলে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে পণ্য আনা-নেয়া সহজ হবে। এতে সময় ও খরচ কমে যাবে। তাই ওই অঞ্চলে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ প্রকাশ করবেন।’
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা মানেই তো ওভারহেড। এটা অবশ্যই ভালো একটা দিক। এতে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যবসায়িক সুফলও মিলবে। ব্যবসায়িক সুফল বলতে ওখানের পোটেনশিয়ালিটি বিবেচনা করতে হবে। আমাদের ওই অঞ্চলে ব্যবসা বলতে সবগুলোই কৃষি নির্ভর। তাই কৃষি নির্ভর ব্যবসাগুলোই বিশেষ করে উৎসাহিত হবে। উৎপাদনকারীরা সহজে সফল হবে। তবে অতি উৎসাহী হওয়া যাবে না। এতে লাভের পাশাপাশি অনেক সতর্কতাও অবলম্বন করতে হবে।’
ভাড়া ও রেল চলাচলের সময়সূচি
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা নতুন ট্যুরিস্ট কোচ দিয়ে এ রেলপথের যাত্রীরা ভ্রমণ উপভোগ করবেন বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তা। ১ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে রেল চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মো. সিরাজ-উদ- দৌলা খান বলেন, ‘যাত্রীদের কথা মাথায় রেখে এ রুটের জন্য সস্পূর্ণ নতুন ট্যুরিস্ট কোচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব কোচে বড় আকারের জানালাসহ বাইরের দৃশ্য উপভোগ করার বিভিন্ন সুবিধা সংযুক্ত করা যাবে। রেলওয়ে মহাপরিচালকের কার্যালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, দিনে একটি ট্রেন ঢাকা থেকে রাত ৯টা ১০ মিনিটে যাত্রা করে বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রাম স্টেশনে বিরতি দিয়ে সকাল সাড়ে ৬টায় কক্সবাজারে পৌঁছাবে। কক্সবাজার থেকে দুপুর ১টায় যাত্রা করে রাত ৯টা ১০ মিনিটে ঢাকায় ফিরবে। ফিরতি পথেও চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি থাকবে। ট্রেনটির সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে মঙ্গলবার।’
এ রেলরুটের ভাড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ের কারিগরি কমিটি। ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী ঢাকা থেকে কক্সবাজার নন-এসি অর্থাৎ শোভন চেয়ারে ৫১৫ টাকা ও এসি সিটে ৯৮৪ টাকা ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। এসি সিটে ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ ভাড়া হবে ১ হাজার ১৩২ টাকা। ভ্যাটসহ এসি কেবিনে ১ হাজার ৩৬৩ ও এসি বার্থে ভাড়া পড়বে ২ হাজার ৩৬ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে বর্তমানে নন-এসি বাসের ভাড়া ৪২০ টাকা ও এসি চেয়ার ৮০০ টাকা। কিন্তু ট্রেনের একই ধরনের (আন্তঃনগরে শোভন চেয়ার) টিকিটের ভাড়া রাখা হয়েছে মাত্র ২২০ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সাধারণ দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাড়া ৫৫ টাকা ও আন্তঃনগর ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩৪ টাকা। আর প্রথম শ্রেণীর সর্বোচ্চ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৪৮ টাকা।
তবে প্রাথমিকভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে তূর্ণা নিশীথার বগি দিয়ে চালানো হবে ঢাকা-কক্সবাজারের ট্রেন। পাশাপাশি তূর্ণা নিশীথায় বিকল্প রেক দেওয়া হবে। ট্রেনে দুটি খাবার বগি, একটি পাওয়ার কার, তিনটি এসি কেবিনের বগি, পাঁচটি এসি চেয়ারের বগি, ছয়টি শোভন চেয়ারের বগি এবং একটি নন-এসি ফার্স্টক্লাস সিটের বগি থাকবে। ঢাকা থেকে যাত্রার সময় আসন সংখ্যা হবে ৭৯৭। ফিরতি পথে আসন হবে ৭৩৭।