ভূঁইয়া নজরুল »
স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সেতু বললে ভুল হবে, বাঙালি জাতির গর্বের প্রতীক। শুধু এই সেতু দিয়েই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়। বিশ্বের যতো খরস্রোতা নদী রয়েছে তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রমত্তা এই পদ্মা। ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর মাধ্যমে এই প্রমত্তা নদীকে বশে এনে পুরো বাংলাদেশ এখন এক বন্ধনীতে আবদ্ধ হলো। পদ্মা নদীর কারণে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা দেশের ২১টি জেলায় এখন সড়ক ও রেলপথে যাতায়াত করা যাবে। এতে শুধু এই অঞ্চল নয়, পুরো দেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। বাড়বে কর্মসংস্থান, বাড়বে জিডিপি।
এই সেতুর কারণে নতুন এক অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠবে বলে উল্লেখ করেন অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বার বার শুধু বলা হচ্ছে পদ্মা সেতু হলে ঢাকার সাথে যাতায়াত সহজ হবে। সহজে দক্ষিণাঞ্চল থেকে কৃষিপণ্য ঢাকায় পৌঁছে যাবে। যদি এটাই হয় তাহলে সরবরাহকৃত কৃষিপণ্যে উদ্বৃত্ত হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে এই ২১ জেলার পণ্য সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। এতে লাভবান হবে সারাদেশ।’
তিনি আরো বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশে নতুন আরেকটি অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠবে। পদ্মা সেতু হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো এর সাথে যুক্ত হবে এবং মোংলা ও পায়রা বন্দরের সাথে নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। বর্তমানে ঢাকা, কুমিল্লা হয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ও মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে।
বন্দর হলো দেশের উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম। এই বন্দরের সাথে নেটওয়ার্ক যতো বেশি বাড়ানো যায় ততোই এর বহুমুখী ব্যবহার বাড়বে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্র বন্দর রয়েছে পদ্মার ওপারে। এই সেতুর কারণে ওই এলাকায় শিল্পায়ন হবে উল্লেখ করে চিটাগাং চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এতোদিন দক্ষিণের ২১ জেলায় শিল্পায়নের তেমন সুযোগ ছিল না। এখন পদ্মা সেতুর কারণে যাতায়াত সহজ হবে বলে সেখানে বিনিয়োগ বাড়বে। এতে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে এবং মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
এতে চট্টগ্রাম অঞ্চল কতটুকু লাভবান হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ২১ জেলা পুরো দেশের সাথে কানেকটিভিটি পাচ্ছে। এতে সারা দেশই লাভবান হবে। চট্টগ্রাম থেকে দ্রুত পণ্য ওই এলাকায় যাবে এবং সেখান থেকে এখানে আসতে পারবে।’
শিল্পায়নের বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শিল্পায়নের প্রধান শর্ত হলো শ্রমিক সরবরাহ ও ভূমির প্রাপ্যতা। আর এরপরই আসবে যাতায়াত, গ্যাস ও বিদ্যুতের সহজলভ্যতা। এসব বিষয় নিশ্চিত করা গেলে অবশ্যই এতোদিন পিছিয়ে থাকা দক্ষিণের ২১ জেলায় শিল্পায়ন হবে এবং মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। আর এসবের কারণে জাতীয় জিডিপি ২ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।’
কিন্তু এতে পোশাক শিল্প কতটুকু লাভবান হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করে বর্তমানে চট্টগ্রামের পাশাপাশি ঢাকায় পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। আগামীতে দক্ষিণাঞ্চলেও কারখানা গড়ে উঠতে পারে। এতে আমাদের পোশাক খাত লাভবান হবে।
এদিকে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ২০ দেশের বিশেষজ্ঞরা এতে যুক্ত হয়েছেন। ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি, ৯ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি ও ৯ সদস্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ে বাস্তবায়ন হওয়া এই পদ্মা সেতু পরনির্ভরশীলতার অচলায়তন ভেঙে নির্মিত হয়েছে। প্রতি সেকেন্ডে সবচেয়ে বেশি পানি প্রবাহের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ নদী পদ্মা। এই নদী দিয়ে সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হয়। তাই পদ্মার নদী শাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নদী শাসনে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত। এবিষয়ে তিনি মিডিয়াকে বলেছিলেন, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এই দুই নদীর মিলিত শক্তি হলো পদ্মা। এজন্য নানা দিক দিয়ে পদ্মা সেতু বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিধি বাড়বে
এদিকে পদ্মা সেতু হলে মোংলা ও পায়রা বন্দরের গুরুত্ব বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের সমকক্ষ কারো হওয়ার সুযোগ নেই। প্রাকৃতিকভাবেই চট্টগ্রাম বন্দর গড়ে উঠেছে এবং এই বন্দরের নাব্যতা পায়রা বা মোংলা বন্দরের চেয়ে বেশি। পায়রা ও মোংলা নাব্যতা সঙ্কটের কারণে অনেক জাহাজ ভেড়াতে পারে না। তাই পদ্মা সেতু চালুর পর আমাদের কার্যক্রম আরো বাড়বে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে সহজে পণ্য দেশের দক্ষিণাঞ্চলে চলে যেতে পারবে। রপ্তানি পণ্য ফ্রোজেন ফুডগুলো দ্রুত পরিবহন সেবা পাবে। এছাড়া পাটসহ অন্যান্য পণ্যের পরিবহনও সহজতর হবে।’
উল্লেখ্য, আজ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। এই সেতু নিয়ে সারাদেশে চলছে উৎসবের আমেজ।