সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

এম. আনোয়ার হোসেন :

২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা কর্তৃক ‘শ্রোতা জরিপ’ নামে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির যে জরিপ চালানো হয়, তাতে অষ্টম স্থানে রয়েছেন ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় সর্বমোট ২০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিদ্যাসাগর ছিলেন মূলত উনিশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, গদ্যকার ও সমাজ সংস্কারক। বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা প্রচলন, বাল্য বিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ করতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।  তিনি মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। অনেক সময় তিনি চরম অর্থ সংকটে থাকা সত্ত্বেও ঋণ করে পরোপকার করেছেন নিশ্চিন্তে। অসহায়, দরিদ্র, পীড়িত কিংবা অভুক্ত তার দ্বার থেকে কখনো শূন্য হাতে ফিরে যায়নি। বাংলা ভাষার নব জাগরণে এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে বিদ্যাসাগর ছাড়াও ‘দয়ার সাগর’ নামেও পরিচিত ছিলেন।

হিন্দু সমাজে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সংরক্ষণশীল পরিবার বিধবা বিবাহ প্রথার তীব্র নিন্দার মধ্যেও বিদ্যাসাগর সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি এটিকে সামাজিক আন্দোলনে পরিনত করেন এবং বিধবাবিবাহের একটি আইন প্রনয়ণের সংগ্রামে এগিয়ে চলেন। এ বিষয়ে তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে পত্রিকায় বেনামে লিখেন। পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও তিনি বাল্য বিবাহের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেন। পাশাপাশি নারী শিক্ষার জন্যে তিনি যুগোপযোগী কর্মসূচিও গ্রহণ করেছিলেন। এ সব আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সফল হয়েছিলেন। তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে জাত, বর্ণবৈষম্য দূরীভূত করতেও সমর্থ হয়েছিলেন। ফলে তার শত্রুরও অভাব ছিল না। এক সময় তাকে নিঃশেষ করার জন্যে হিন্দু রক্ষণশীল সমাজ ওঠেপড়ে লাগে। বিধবাবিবাহ প্রথা চালু করতে তিনি তার এক ছেলেকে বিধবা নারীর সাথে বিবাহ দেন। এ ছাড়াও তার এক সহকর্মী কলেজ শিক্ষক বন্ধুকেও তিনি বিধবার সাথে বিয়ে দিয়ে বিধবাবিবাহ প্রথা সমাজে চালু করেন। রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতা কিংবা নিন্দার ঝড়ও কম ছিল না। তবু তিনি এগিয়ে গেলেন। হয়তো এ সমস্ত কারণে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাকে ‘করুণাসাগর’ উপাধি দিয়েছিলেন। এ উপাধিতেও বিদ্যাসাগর সমাজে পরিচিত ছিলেন।

১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করার  পরে বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষার প্রধান পন্ডিতের পদ লাভ করেন। তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। এ সময় ব্রিটিশ সরকার তাকে স্কুল পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়। এই সুবাদে তিনি দুবছরে প্রায় ২০ টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যে তিনি একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। তিনি সকল শ্রেণির হিন্দুদের পড়ার জন্যে সংস্কৃত কলেজের দ্বার উন্মোক্ত করেন।

কখনো পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। তিনি কর্মজীবনে যেমন ছিলেন জেদী, তেমনি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। তিনি বাংলা শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যে অসংখ্য গ্রন্থও রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে- বর্ণপরিচয় ( ১ম,২য় ভাগ, ১৮৫৫), সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমনিকা (১৮৫১), ঋজুপাঠ (১ম,২য় ও ৩য় ভাগ, ১৮৫১-৫২), ব্যকরণ কৌমুদী (১৮৫৩), অনুবাদ গ্রন্থ- হিন্দি থেকে বাংলা ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭), সংস্কৃত থেকে বাংলা শকুন্তলা ( ১৮৫৪), সীতার বনবাস (১৮৬০), ইংরেজি থেকে বাংলা ‘বাঙালার ইতিহাস (১৮৪৮) জীবনচরিত (১৮৪৯), নীতিবোধ (১৮৫১), বোধোদয় ( ১৮৫১), কথামালা (১৮৫৬), চরিতাবলী ( ১৮৫৭), ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬১) প্রভৃতি। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে কিছু পাঠ্যপুস্তক পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালি শিশুদের মৌলিক শিক্ষার বাহন ছিল। বিদ্যাসাগরের এই পরিশ্রম,আন্দোলন পরবর্তীতে সমগ্র বাঙালি জাতিকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে নি:সন্দেহে।

হিন্দু সমাজের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে মেরুদ- সোজা করে দাঁড়ানোর মধ্যেই ছিল বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়। বাংলা গদ্যে তার অবদান যেমন অপরিসীম, তেমনি বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তার অবদান অসামান্য। অক্সফোর্ডের ঐতিহাসিক অধ্যাপক তপন রায় চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন,- ‘ঈশ^রচন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল তার স্বাধীন চিন্তা-চেতনায়, শিক্ষাক্ষেত্রে এবং সমাজ সংস্কারে।’ প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন যুগপুরুষ এবং শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তিনি যেমন হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে হিন্দু বিধবা নারীদের অসহ্য জ¦ালা থেকে মুক্তি এনে দেন, তেমনি তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে নারী শিক্ষা প্রবর্তন, বাংলা শিক্ষার প্রসার ও সাধারণ শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি কালের এক মহা ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

 

লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক