সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার :
কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়া গ্রাম। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করলো একটি ছেলে। মা আদর করে ডাকতেন টুনু। টুনুর আসল নাম জয়নুল আবেদিন। গ্রামের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে জয়নুল বেড়ে উঠতে লাগলো। স্কুলে যাবার বয়স হলে বাবা একদিন জয়নুলকে স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। লেখাপড়ায় খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না জয়নুল। স্কুলের গৎবাঁধা লেখাপড়া ভালো লাগে না তার। জয়নুলের মনটা যেনো প্রজাপতির মতো উড়ো-উড়ো, চঞ্চল। ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েরা যখন লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত, জয়নুলের মন তখন ঘুরে বেড়াতো প্রকৃতির আনাচ-কানাচে। সময়ে-অসময়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে যেতো নদীতীরে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখতো খৈরঙা পালের নৌকাগুলোর তরতর করে ছুটে যাওয়া, দেখতো পল্লিবালাদের কলসিকাঁখে জলকে চলার দৃশ্য, দেখতো গাড়োয়ানদের গরুগাড়ি চালানোর দৃশ্য। ঝোপঝাড়ে কোনো ফুল কিংবা পাখি দেখলে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো জয়নুল। শুধুই কি দেখা? রং পেনসিল, কাগজ নিয়ে জয়নুল তার প্রিয় দৃশ্যগুলোর ছবিও আঁকার চেষ্টা করতো। রং পেনসিল, কাগজ কিনে দেয়ার জন্যে জয়নুল মা-বাবার কাছে বায়না ধরতো। ছবি আঁকাআঁকির জন্যে বাবা একটু-আধটু গালমন্দ করতেন। কিন্তু মা এ ব্যাপারে একটুও কড়াকড়ি করতেন না। উৎসাহ দিতেন। মায়ের উৎসাহে জয়নুলের ছবি আঁকাআঁকি দিন দিন বাড়তে লাগলো। হাতও একটু-একটু পাকা হতে লাগলো। কালের গতিতে সেই ছেলেটি হলো বর্তমানের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
স্কুলের গ-ি পেরিয়ে জয়নুলের এবার কলেজে ভর্তি হবার পালা। ছেলের আগ্রহ অনুসারে মা-বাবা স্থির করলেন কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি করাবেন তাকে। কলকাতার কলেজে লেখাপড়া করা তো অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। কী আর করা, মা নিজের গলার হার বিক্রি করে দিয়ে ছেলে জয়নুলকে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। মনের ঝোঁক অনুযায়ী লেখাপড়ার ক্ষেত্র পেয়ে জয়নুলের মন আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। জয়নুলও এবার লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়ে গেলেন। কলেজের প্রতিটি পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দিতে লাগলেন। অসাধারণ প্রতিভা দেখে শিক্ষকেরাও জয়নুলের প্রতি বিশেষ নজর দিতেন। জয়নুল এতোই মেধাবী ছাত্র ছিলেন যে, পঞ্চমবর্ষের ছাত্র থাকাকালে তিনি আর্ট কলেজে শিক্ষকতার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সমাপনী পরীক্ষায় জয়নুল প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে চমৎকৃত করেছিলেন।
ইতিমধ্যে গণ্যমান্য চিত্রশিল্পী হিসেবে জয়নুল আবেদিনের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। যামিনী রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বিখ্যাত চিত্রশিল্পীগণ জয়নুলের পরামর্শ নিতেন কীভাবে ভারতীয় চিত্রকলাকে আরও বেগবান করা যায়।
১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের ওপর কিছু ছবি এঁকে জয়নুল আবেদিন বিশ্বের চিত্রামোদীদের মনজয় করেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তিনি ছবি আঁকতেন। তবে গ্রাম, অবহেলিত জনপদ, ছিন্নমূল মানুষ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের ওপর ছবি আঁকাকে তিনি প্রাধান্য দিতেন। বিষয়বস্তুতে ফুটে উঠতো তাঁর দরদি মনের ছবি। তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে আছে নৌকা (১৯৫৭), সংগ্রাম (১৯৫৯), বীর মুক্তিযোদ্ধা (১৯৭১), ম্যাডোনা প্রভৃতি। তাঁর দুটি বিখ্যাত স্ক্রল চিত্রকর্ম আছে, একটি হলো নবান্ন (১৯৫৯)। চিত্রটি দৈর্ঘ্যে ৬৫ ফুট। অন্যটি মনপুরা (১৯৭০)। এটি দৈর্ঘ্যে ৩০ ফুট।
খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন আর্টস বিষয়ক ফাংশনে জয়নুল আবেদিনের ডাক পড়তো। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, মেক্সিকো, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মিসর, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে। তিনি রকফেলার ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ পান। তেহরান আন্তর্জাতিক শিল্পকলা প্রদর্শনীতে তিনি বিচারক হিসেবে মনোনীত হন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘হিলাল-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি দিয়েছিল।
শুধু শিল্পী নন, জয়নুল আবেদিন ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, সংস্কারক ও জাঁদরেল প্রশাসকও। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট, সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর, পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ফাইন আর্টস ফ্যাকাল্টি, করাচি আর্টস গ্যালারি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠায় জয়নুল আবেদিনের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মানুষ হিসেবেও জয়নুল আবেদিন ছিলেন সুন্দর হৃদয়ের অধিকারী। তাঁর মধ্যে ছিল অতুলন বন্ধুপ্রীতিও।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশিল্পে মহান কীর্তির সৃষ্টি করে আমাদের দেশ ও জাতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে এনেছেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ২৮ ইহকাল ত্যাগ করেন। কর্ম ও কীর্তির জন্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আমাদের অন্তরে হয়ে থাকবেন চিরঅমর।