ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়ক
ভূঁইয়া নজরুল
ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়ক। অনেকের কাছে বায়েজীদ লিংক রোড নামে পরিচিত। পাহাড় কেটে গড়ে তোলা এই রোডটি আবার দর্শনার্থীদের অনেক পছন্দের। একইসাথে পণ্য পরিবহনেও এ রোডে যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু তিন বছর আগে এ রোডের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হওয়ার পরও রেললাইনের ওপর ওভার ব্রিজ নির্মাণ কাজ অর্ধসমাপ্ত থাকায় রোডের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
গত মঙ্গলবার ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ রোড ঘুরে দেখা যায়, এই রোড দিয়ে তিনটি রেল লাইন গিয়েছে। একটি রেললাইন ফৌজদারহাট থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের সিজিপিওয়াই ইয়ার্ডে (বন্দরের সাথে পণ্য পরিবহনের রেললাইন), অপর দুটি রেল লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের। এই তিনটি রেললাইনের উপর ওভার ব্রিজ নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে সব কাজ শেষ হলেও চারটি পিলারের (৪, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর পিলার) তিনটি স্প্যানে গার্ডার বসানোর কাজ বন্ধ। এতে চার লেন চওড়া ও ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রোডের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চট্টগ্রামবাসী।
গার্ডার বসছে না কেন ?
১৯৯৭ সালে ৪০ কোটি টাকায় ছয় দশমিক চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে রোডটি বাস্তবায়নের প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। দুই লেনের সেই প্রকল্পের আওতায় একটি ওভার ব্রিজ নির্মাণের পর প্রকল্পটি অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে নতুন আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে দুই দফায় সংশোধন করে ৩২০ কোটি টাকায় ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড ও বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সাথে সংযোগ করে রোডটিকে চার লেনে উন্নীত করা হয়। রোডের সব কাজ ২০২০ সালে শেষ হওয়ার পর পুরনো ব্রিজ দিয়ে গাড়ি চলাচল করলেও নতুন ওভার ব্রিজটি শেষ করা যায়নি। এবিষয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ( সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন,‘ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রেল লাইনের উচ্চতা জটিলতার কথা বলে আমাদেরকে ওভার ব্রিজ নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে না। এতে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাচ্ছে না।’
কেন দেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পথ) মোহাম্মদ আরমান হোসেন বলেন,‘ সারাদেশে রেললাইনের উপর ওভারপাস বা ওভারব্রিজ নির্মাণের জন্য উচ্চতার ক্ষেত্রে রেলওয়ের একটি অর্ডিনেন্স রয়েছে। সেই অর্ডিনেন্সে রেল লাইন থেকে উপরের দিকে ৮ দশমিক ৫ মিটার রাখতে বলা হয়েছে। নিশ্চয় এই ব্রিজটি এর চেয়ে কম উচ্চতার। তাই হয়তো অনুমোদন পেতে সমস্যা হচ্ছে।’
সিডিএ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের প্রকল্পের আওতায় নির্মিত বর্তমান ওভারব্রিজটির উচ্চতা ৬ মিটারের কম। নির্মাণাধীন ওভারব্রিজে রেললাইনের উপর রয়েছে ৭ দশমিক ৬ মিটার। রেলওয়ে বিধান অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রেললাইনের উপরে ৭ দশমিক ৫ মিটার উচ্চতা খালি রাখতে বলা হয়েছিল। ২০১৬ সালের পর তা বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ মিটার করা হয়। আর এতেই বিপত্তি দেখা দেয়।
এবিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন,‘ রেললাইনের উপরে কতটুকু খালি রাখা হবে তা কয়েক বছর পর পর পরিবর্তন করা যায় না। তাহলে তো বছর বছর ওভারপাস ও ওভারব্রিজগুলো ভাঙতে হবে।’
উচ্চতা বাড়লো কেন?
বর্তমানে মিটারগেজ রেললাইন দিয়ে একটি কনটেইনার নিয়ে যেতে তিন দশমিক ৮ মিটার এবং ব্রডগেজে ৪ দশমিক ৫ মিটার উচ্চতার দরকার হয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আগামীতে রেললাইন দিয়ে দুই তলায় ( ডাবল কনটেইনার) কনটেইনার পরিবহনের পরিকল্পনা নিয়েছে। আর সেকারণে রেললাইনের উপরে কতটুকু অংশ খালি রাখতে হবে সেই উচ্চতা বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক ( প্রকৌশল) মামুনুল ইসলাম বলেন, ‘রেলওয়ের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রয়েছে রেললাইনের উপর দিয়ে ডাবল ডেকার কনটেইনার পরিবহন করা। সেই পরিকল্পনা থেকে রেললাইনের উপরে বেশি উচ্চতা ( ৮ দশমিক ৫ মিটার) রাখার আইন করা হয়েছে।’ এদিকে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে রেললাইনের উপর সারাদেশে যতো ফুটওভার ব্রিজ, ওভারপাস ও ওভারব্রিজ রয়েছে সবগুলোর উচ্চতা ৭ দশমিক ৫ মিটারের নিচে।
সমাধান কোথায় ?
জানা যায়, রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের একটি কমিটি এই সমস্যা নিরসনের জন্য কাজ করেছিল। পরবর্তীতে সেই কমিটি প্রস্তাব করেছিল ওভারব্রিজটি যেভাবে নির্মিত হচ্ছিল সেভাবেই নির্মিত হয়ে যাক। পরবর্তীতে বিদ্যমান ওভারব্রিজটি ভেঙে রেলওয়ের আইন অনুযায়ী ৮.৫ মিটার উচ্চতায় নির্মিত করবে। আর এখন যেটি নির্মিত হবে তা ভেঙে বানাতে হলে দুই বছর আগে সিডিএকে জানাবে। সিডিএ প্রকল্প গ্রহণ করে তা নির্মাণ করবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন,‘ আমরা রেলওয়ের এই প্রস্তাবে তা সম্মতি দিয়েছিলাম। কিন্তু মন্ত্রণালয় এখনো তা অনুমোদন দেয়নি। আর এতেই ব্রিজ নির্মাণের কাজ আটকে রয়েছে। চট্টগ্রামবাসীও এই রোডের শতভাগ সুফল পাচ্ছে না।’
এবিষয়ে রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক ( প্রকৌশল) মামুনুল ইসলাম বলেন,‘ ডাবল ডেকার আমাদের দেশে চালু হতে আরো ১৫ থেকে ২০ বছর লাগবে। এছাড়া এই পথে তা চলতে গেলে সারাদেশে রেললাইনের উপর থাকা সব ফ্লাইওভারগুলোও ভাঙতে হবে। তখন না হয় এটিও সেগুলোর মতো ভাঙা হবে। সেই বিবেচনা করে আমরা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিলাম।’
প্রস্তাবিত শর্তে অনুমোদন দেয়ার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সর্বশেষ সংসদীয় কমিটির সভায়ও ডিটি-বায়েজীদ রোড এবং আউটার রিং রোডের ফিডার রোড-৩ এর ওভারব্রিজ নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল।
আউটার রিং রোডের ফিডার রোডেও সমস্যা
শুধু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কেই নয়। জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামের কাছে আউটার রিং রোডের ফিডার রোড-৩ গিয়েছে রেললাইনের (চট্টগ্রাম বন্দরের সিজিপিওয়াই ইয়ার্ডের সাথে ফৌজদারহাটের সংযোগ) উপর দিয়ে। এখানেও ওভারব্রিজটি অর্ধসমাপ্ত। ফলে সাগরিকা প্রান্তে আউটার রিং রোডের সংযোগ হচ্ছে না। এবিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ডিসেম্বরে টানেল চালু হচ্ছে। অতিদ্রুত যদি আমরা আউটার রিং রোডের সাথে প্রধান সড়কের যুক্ত করতে না পারি তাহলে পুরো যাতায়াত ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই অতিদ্রুত নির্মাণের অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন।’
উল্লেখ্য, সিডিএ ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়ক নির্মাণ করায় ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে শহরমুখো গাড়িগুলো চলে আসতে পারে। এতে জাকির হোসেন রোডের উপর চাপ কমেছে এবং জিইসি মোড়ে যানজটও কমেছে। অপরদিকে আউটার রিং রোডের সুফল পেতে তিনটি ফিডার রোডের অন্ততপক্ষে একটি ( সাগরিকা অংশের ফিডার রোড-৩) চালু করতে হবে। অন্যথায় রিং রোডে গাড়ি প্রবেশ ও বের হতে সমস্যা হবে। এই প্রকল্পটিও প্রায় শেষ।