নিজস্ব প্রতিবেদক »
আসন্ন রমজানে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে ‘সংকটের’ কারণে দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। কেননা ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা কোনো ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। অথচ দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এলসি খুলে পণ্য আনার সুযোগ পাচ্ছে কম-বেশি। এতে বাজার একচেটিয়া হয়ে পণ্যের দরে ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়ার আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা।
চক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হাতেগোনা বিকিনিকির মধ্যে ব্যবসায়ীদের কপালে ভাঁজ রমজানের প্রস্তুতি নিয়ে। সাধারণত খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা রমজানের প্রায় দুই মাস আগে থেকে রমজানের বিভিন্ন পণ্য গুদামজাত করে বিভিন্ন এলাকার কমিশন এজেন্ট, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট সরবরাহ করেন। কিন্তু এবার খাতুনগঞ্জের আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের চিত্র দেখা যাচ্ছে ভিন্ন।
ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশে ডলারের দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকটসহ নানা সংকটে অজুহাত দেখিয়ে অধিকাংশ ব্যাংক আগের মতো এলসি (ঋণপত্র) খুলছেন না। খুললেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়িরা এলসি করতে পারছে না। যার ফলে রমজানের পণ্য আমদানিতে কিছুটা বিঘœ ঘটছে। তাই এবার রমজানের পণ্য সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের আড়ত ঘুরে জানা যায়, চলতি মাসের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত ছোলা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭৮ থেকে ৮০ টাকায়। এছাড়া সাদা মটর ৫৯ থেকে ৬২ টাকা, মটর ডাল ৬০ থেকে ৬২ টাকা, চিকন মসুর ডাল ১৩০ টাকা, মসুর ডাল মোটা ৯০ টাকা এবং ভারতীয় গম বিক্রি হচ্ছে মণ প্রতি ১ হাজার ৬৫০ টাকায়। অন্যদিকে সয়াবিন তেল প্রতিমণ ৬ হাজার ৬৮০ টাকা এবং পাম তেল ৪ হাজার ৬০০ টাকা, চিনি ৩ হাজার ৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কেজি প্রতি ভারতীয় মরিচ ৪৬৯ টাকা, হলুদ ১১০ টাকা, রসুন ৯৫ টাকা, আদা ১২০ টাকা এবং পেঁয়াজ (ভারতীয়) বিক্রি হচ্ছে ৩৩ থেকে ৩৫ টাকায়। মশলার মধ্যে কেজি প্রতি এলাচ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা, লবঙ্গ ১ হাজার ৮০ টাকা এবং দারচিনি ৪৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা জানান, বছরের অনান্য দিনের তুলনায় রমজান মাসে চিনি, ছোলা, ময়দা ও মসলা জাতীয় পণ্যগুলোর বেশি প্রয়োজন হয়।
এসবের ব্যবহার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তবে বর্তমানে বাজারে চিনির দাম চড়া হলেও সরবরাহে কোনো ধরনের ঘাটতি নেই। এছাড়া দেশে প্রায় ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকে। তবে এখন পর্যন্ত ছোলার সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। তবে মসলা জাতীয় পণ্যগুলোর মধ্যে জিরা, লং, এলাচ, দারুচিনি, ভারতীয় মরিচ, খেজুর, কমলা, মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর ও নাশপতিসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে হয়। রমজানে এসব পণ্যের আলাদা চাহিদা থাকে। সাধারণত এসব পণ্য আমদানি হয় ইরান, মিশর, তিউনিসিয়া, দুবাই ও সৌদি আরব থেকে।
এদিকে আগামী মার্চে শুরু হতে যাচ্ছে রমজান। সেই হিসেবে ব্যবসায়ীদের হাতে দুমাসের মতো সময় আছে। তাছাড়া এলসি খোলা থেকে শুরু করে মাল আমদানিকৃত মালামাল গুদামজাতকরণ করতে আড়াইমাসের মতো সময় লাগে। বর্তমান যদি এই সংকট কাটিয়ে আসন্ন রমজানের জন্য এলসি খুলে আমদানিকৃত মালামাল গুদামজাত করা না যায় তাহলে রমজান মাসে ভোক্তারা নানা সমস্যায় পড়বেন বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বর্তমান ব্যাংক দেশে ডলার সংকটের কথা বলে ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা নির্দেশনা থাকলেও ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি নিচ্ছে না বলে খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকরা অভিযোগ করেছেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীরা কিছু প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করেছে।
খাতুনগঞ্জের ছোলা-ডালের আমদানিকারক ও বর্ষা এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারী বিশ্বজিৎ মহুরী বলেন, ‘ছোলা-ডালের আমদানি এবার আমরা করতে না পারলেও টিকে গ্রুপ, বিএসএম গ্রুপ ও নাবিল গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানরা আমদানি করছে। আশা করি, পণ্যে সংকট থাকবে না। দামের ব্যাপারে প্রশাসনের যথাযথ নজরদারি থাকলে কোনো সমস্যা হবে না।’
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘সাধারণত প্রতিবছর রমজানের তিন চার মাস আগে থেকে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানির কাজ শুরু করেন। তবে এবছর বড় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ এলসি খোলার সুযোগ পেলেও ছোট ও মাঝারী ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ পাচ্ছে না। গত এক মাস আগে এলসি করতে পারলেও এখন ব্যাংকগুলো বড় বড় ব্যবসায়ীদের ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সে সুযোগ পাচ্ছে না।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এলসি করতে পারছে না। সামনে রমজান। এলসি করে দেশে পণ্য আসতেও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। যদি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা যদি এখন এলসি খুলতে না পারে দেশের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা হারাবে। বাজার ব্যবস্থা বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এতে রমজানে নিত্যপণ্যের বাজারে ভোক্তারা ভোগান্তিতে পড়বে বলে মনে করি।’
এ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। না হয় আসন্ন রমজানে যদি পর্যাপ্ত মালামাল আমদানি না হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে।’