মাছুম আহমেদ »
মানুষ স্বার্থপর। প্রায় সকল দার্শনিকই এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত। তারা এও মনে করেন, স্বার্থপরতা মোটেও দোষণীয় নয়। মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই এই স্বার্থপরতা অন্তর্লীন। একটি শিশুকে পর্যবেক্ষণ করলেই একথার প্রমাণ মেলে। শিশুর কান্না ওর স্বার্থ জানান দেওয়ার হাতিয়ার। শিশুটির কোনো প্রত্যাশার আহবান কান্নার মাধ্যমে পরিবেশিত হয়। ‘আমার সেটি চাই-ই চাই’ এমন মনোবৃত্তিই শিশুর ক্ষেত্রে পরিদৃশ্য হয়। এ স্বার্থপরতা মানুষের প্রকৃতিজাত স্বাভাবিক আচরণ। তবে, বড়দের বেলায় এই একমুখি স্বার্থপরতা ব্যক্তিভেদে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিংবা আত্মস্বার্থের প্রশ্নে একই ব্যক্তির মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান তৈরি হয়। এমনটি হয় ব্যক্তির যুক্তিবোধের কারণে। এ বোধের কারণেই ব্যক্তির নিজের মনের মধ্যে উপলব্দির একটি আয়না নির্মিত হয়। ওই বোধ যত গভীর হয় তার মনের আয়না তত স্বচ্ছ হয়। ব্যক্তি তখন সহজেই নিজের স্বার্থের সমান্তরালে অন্যের বাসনা-কামনাকেও উপলব্ধি করতে পারে। যুক্তি-বুদ্ধির আশ্রয়েই মানুষ তার একমুখি স্বার্থের পশুত্ববৃত্তি জয় করে মনুষ্যবৃত্তির পথে এগিয়ে যায়। একটি শিশুর মধ্যে যুক্তিবোধের অংকুরোদগম হলেও সেই বোধ পরিপুষ্ট হয় তার অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোয়। একইভাবে একজন মস্তিষ্কবিকৃত ব্যক্তির মধ্যে সেই বোধ জাগ্রত থাকে না বলেই তার স্বার্থ কেবল আত্মমুখি হতে পারে।
যুক্তিবোধ নির্মাণের একটি অনন্য হাতিয়ার হলো গণিত। অপরাপর সব বিজ্ঞানের মধ্যে যুক্তিবোধ নির্মিতির উপাদান থাকলেও গণিতে সেই উপাদান সরাসরি কাজ করে। তাই গণিত-পরিসংখ্যান যুক্তিবোধ গঠনে এবং প্রকান্তরে মনের ভেতর আয়না তৈরির ব্যাপারে ঘনিষ্ট ভূমিকা রাখে। তবে, মনের ভেতর ভুবন তৈরির ব্যাপরে আরো ভিত্তিপূর্ণ ভূমিকা রাখে শিল্পকলা তথা শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা। মনের ভেতরে ভুবন নির্মাণের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার আত্মজিজ্ঞাসা, মনন এবং প্রকারন্তরে নিজেকেই ক্রমাগত আবিষ্কার করে। শিল্পকলা, সাহিত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে নিজেকে চেনার বোধ শাণিত হয়। শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা ভাবনার দিগন্ত সুবিস্তৃত ও সুবিন্যস্ত করে। এ ভাবনার তীক্ষèতা মানুষ তথা প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলার পারদর্শিতা-দক্ষতায় পরিপূর্ণ। ‘শেষের কবিতা’য় প্রথম দেখার পর অমিতের চোখে লাবণ্যকে ফুটিয়ে তুলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বললেন: “দুর্লভ অবসরে অমিত তাকে দেখলে। পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না।” প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনার মাহাত্ম মেলে রবীঠাকুরের এমন বক্তব্যে। লাবণ্যের কণ্ঠস্বর বর্ণনায় তিনি লিখলেন: “এ যেন অম্বুরি তামাকের হালকা ধোঁয়া, জলের ভিতর দিয়ে পাক খেয়ে আসছে- নিকোটিনের ঝাঁজ নেই, আছে গোলাপ জলের ¯িœগ্ধ গন্ধ।” মনের ভেতর ভুবন নির্মাণের অনন্য ক্ষমতাই আলোচ্য বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেপথ্য শক্তি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমেই তাঁর সেই শক্তি প্রণোদিত হয়েছে।
আত্ম-উপলব্দি আর আত্মজিজ্ঞাসার পথরেখায় ব্যক্তি নিজেকে সমাজের অপরাপর মানুষের বিপরীতে স্থাপন করে এবং কখনো কখনো নিজেকে অন্যের মধ্যে স্থাপন করে নিজেকে গভীরভাবে চেনার প্রয়াস পায়। এমন ব্যক্তি হয়ে ওঠে নিজের অন্যতম সমালোচক। একজন সভ্য মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ সমালোচনা অনিবার্য ও অপরিহার্য। ধরা যাক, কবিতার কথা। একজন কবি কবিতার মধ্যদিয়ে নিজেকেই প্রকাশ করেন। অন্যের আয়নায় কিংবা ভেতরের ভুবনে স্পষ্ট হওয়া নিজের মানচিত্রই চিত্রিত হয় কবিতায়। কবিতাকে তাই আমরা নাম দিতে পারি ‘আত্মবিশ্লেষণ’। প্রখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও সংস্কৃতি-সমালোচক ম্যাথু আর্নলডও মনে করেন কব্য হলো- “ক্রিটিসিজম অব লাইফ”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতেও কাব্য মানে- “লাইফস কমেন্টারি ইনভার্স”। তবে, শুধু কবিতা নয়, আত্ম-উপলব্ধির বোধ নির্মাণে শিল্পসাহিত্যের অপরাপর সকল উপাদানেরই অশেষ গুরুত্ব বিদ্যমান।
শিল্প-সংস্কতির চর্চা মানুষকে আরেকটি অনন্য উপাদান সরবরাহ করে। সংস্কৃতিবান মানুষ সময়কে তথা সমাজকেও বুঝতে পরে, বিশ্লেষণ করতে পারে। সমাজের রুচি, অবক্ষয় আর প্রকৃত অগ্রগতি বুঝবার ক্ষমতা ও দক্ষতা বিনির্মাণে শিল্প-সংস্কতির ভূমিকা অভিভাবকসুলভ। সমাজ বাস্তবতা বোঝবার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীলতার বোধও তাড়িত হয় একজন শিল্পমনস্ক মানুষের মধ্যে। শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর সামাজিক দায়ই সভ্যতা নির্মাণের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সংস্কৃতিবান তারুণ্য সেই দায় মননে ধারণ করে নেত্বত্ব দেওয়ায় উদ্দীপ্ত হয়। রাজনীতির প্রকৃত পাঠ উদঘাটনে তারুণ্য তখন আগ্রহী হয় এবং জনমানুষের জন্য আত্মনিয়োগের বাসনাবোধে উজ্জীবিত হয়। শিল্প-সংস্কতি চর্চায় দারিদ্র তাই তারুণ্যকে রাজনীতির প্রকৃত নির্যাস থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে রাজনীতিবিমুখ করে তোলে। পরিতাপের বিষয় কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক গবেষণা দেখা গেছে বাংলাদেশের ৭৪ শতাংশ তরুণই রাজনীতিবিমুখ। সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নির্মাণে এ তথ্য কোনো শুভ বার্তা বহন করে না। বলা বাহুল্য, একটি দেশের অবগাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত উন্নতির চেয়ে মানবিক-রাজনৈতিক তারুণ্য গঠন অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে তরুণদের জন্য সুন্দর আগামী নির্মাণের চেয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বর্তমান তরুণদের শিল্প-সংস্কতির দৃঢ় সংস্পর্শে গড়ে তোলা অধিকতর জরুরি। মুক্তিবুদ্ধি বা যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন এবং মানবিক তারণ্য গড়া গেলে দেশ আপনা-আপনিই সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
যুক্তিবোধ মানবিকবোধে উন্নীত হয় শিল্পকলার চর্চায়। শিল্পকলার পাঠ যত বেশি, মনের ভেতর ভুবন তৈরির ক্ষমতা তার তত বেশি। আর ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করেন, মনের ভেতর ভুবন তৈরির ক্ষমতা যার যত বেশি, দুঃখ-কষ্ট বা যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার তত বেশি। জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ারও একই মত পোষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, শিল্পকলার চর্চা মানুষের মননে প্রতিনিয়ত সৌন্দর্যবোধের বীজ বোনে। আর সেই বোধ অন্ধ আত্মস্বার্থের কামনা-বসনার বিরুদ্ধে পরার্থবাদের বাঁধ নির্মাণ করে। এতে মানুষের অপ্রাপ্তিজনিত অপূর্ণতার শোক অন্যের স্বার্থের জন্য কাজ করার শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। শোপেনহাওয়ারের আগেও আরেক জার্মান ভাববাদী ফ্রেডরিক শেলিং শিল্পকলার শক্তির জয়গান গেয়েেেছন। তিনি বলেছেন, শিল্পকলায় প্রাজ্ঞ একজন ব্যক্তি অন্য যেকোনো বিষয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির চেয়ে সবসময় উচ্চ অবস্থান পাওয়ার যোগ্য। কেননা তিনি মনে করেন, একজন শিল্পী পুরো বিশ্বজগতকেই উপলব্ধি করতে পারেন যেখানে অন্যরা কেবল খ-িত জগতের উপলিব্ধতেই সীমাবদ্ধ।
বিশ্বজগতের উপলব্ধিক্ষম মানুষ সহজেই আত্মস্বার্থকে তুচ্ছতুল্য বিবেচনা করতে পারে। বোধের গভীরে প্রবেশের মধ্যদিয়ে সেই মানুষ সৃষ্টির রহস্য ভেদ করায় মনোনিবেশ করে। একটি উচ্চতর সৃজীনশীল আনন্দ সেই মানুষকে সবসময় জড়িয়ে থাকে। এই অপার আনন্দের তৃপ্তি মানুষের একমুখি আত্মস্বার্থপরতার স্বাদকে তেতো করে তোলে। বিখ্যাত অস্ট্রীয় মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড সেই তৃপ্তিকেই উচ্চতর আনন্দ বা হাইয়েস্ট প্লেজার নামে অভিহিত করেছেন। এ কাতারে তিনি রেখেছেন বিশ্বখ্যাত ইতালীয় চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে। একটি নিখুঁত চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে ভিঞ্চি যে আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন তা বৈষয়িক আপাত কোনো স্বার্থ চরিতার্থের সঙ্গে তুলনা চলে না। আত্মস্বার্থের আপাত তৃপ্তিকে ফ্রয়েড তাই নি¤œতর আনন্দ বলে অভিহিত করেছেন। নি¤œ রুচির মানুষই কেবল সেই তৃপ্তিতে তাড়িত হয়ে সেটির পেছনে পেছনে ছোটে। শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা মানুষের সেই তাড়নাকে সংকীর্ণ প্রতীপন্ন করে মানবিক বোধ জাগ্রত করে।
গ্রিক দার্শনিক প্লেটোও তাই মনে করেছেন। তাঁর মতে, কামনা-বাসনা আর আবেগের দুটি দানব সবসময় আমাদের মনের মধ্যে আত্মস্বার্থের প্রণোদনা যোগায়। এ দানবদুটো নিজের আপাত তৃপ্তির ক্ষেত্রে একেবারেই অন্ধ। দানবিক এ উপাদান দুটোকে কেবল একটি অস্ত্র দিয়েই বশ করা যায়। প্লেটো এই অস্ত্রেও নাম দিয়েছেন যুক্তি বা প্রজ্ঞা। তিনি মনে করেন, যুক্তির আলোই কেবল মানবিক বোধ নির্মাণ করতে পারে, যার মাধ্যমে অন্ধ দুই দানবকে কড়া শাসনে রাখা যায়।
সুতরাং, যুক্তিবোধের মানবিক হাতিয়ার তৈরির অনন্য মাধ্যম হলো শিল্পকলা বা শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা। এ চর্চা যত কমবে মানুষ তত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। একইভাবে শিল্পচর্চা ব্যাহত হলে মুখ থুবড়ে পড়বে মানবতা। উজ্ঝলতা হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়বে উৎসব। পতিত মানবতায় অসাম্প্রদায়িকতা আর শিল্পকলার চাষাবাদেই বাসযোগ্য মানবিক পৃথিবী গড়ার একমাত্র বিকল্প হতে পারে।
বলা বাহুল্য, আত্মস্বার্থে উন্মুখ আর যুক্তিতর্কে বিমুখ ব্যক্তি বিজ্ঞানকে প্রতিপক্ষ ভাবে, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে ভাবে শত্রু। প্রজ্ঞাশূন্য ব্যক্তি শত্রুকে ঘায়েল করতে ধর্মকে হাতিয়ার প্রতিপন্ন করে, বিষ ছড়ায় সাম্প্রদায়িকতার। সমস্ত যুদ্ধ-সংঘাত-সংঘর্ষের শেকড়জুড়েই রয়েছে নির্বোধ আবেগ, অন্ধ স্বার্থপরতা আর আক্রোশের অন্ধকার।
হাজার বছর ধরে শাসন-শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সেই অন্ধকার আমাদের সুস্থ চেতনাকে গ্রাস করেছে বটে। তবে, বাঙালির সমস্ত বিভাজন-দ্বিধা-বিভক্তি ঘুচিয়ে মিলনের আলোকিত আশ্রয় হয়ে বুকে আগলে রেখেছে পহেলা বৈশাখ। অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবিক সংস্কৃতি তথা সম্প্রীতির অনন্য পটভূমি এই মহোৎসব! এবারের পহেলা বৈশাখ মানবিক মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে উদযাপিত হোক, সেটিই প্রার্থনা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।