ধ্বংসের মুখে প্রিন্টিং ও প্রকাশনাশিল্প

কাগজের উচ্চমূল্য, সামনে আসছে একুশের গ্রন্থমেলা

রাজিব শর্মা

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সামনের ফেব্রুয়ারি মাসেই। মধ্য জানুয়ারিতেও নগরীর প্রেসপাড়া হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম বিভাগের সর্ববৃহৎ প্রকাশনা ও বই ব্যবসাকেন্দ্র আন্দরকিল্লা এলাকার প্রেসগুলোতে বই ও শিক্ষাসামগ্রী প্রকাশে কোনো তোড়জোড় নেই তেমন। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও বইমেলার সময় ঘনিয়ে আসলেও প্রকাশনা ও বই বাঁধাইয়ের মুদ্রণালয়গুলোর মধ্যে ব্যস্ততা নেই। এ পরিস্থিতির জন্য প্রেস ব্যবসায়ীরা দুষছেন কাগজের চড়ামূল্য এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্বহীনতাকে।

গতকাল রোববার নগরীর লালদীঘি, হাজারী লেন, আন্দরকিল্লা, রাজাপুকুর লেন, চেরাগী এলাকা ও জামালখান ঘুরে দেখা যায় প্রেস মালিকেরা অলস দিন কাটাচ্ছেন। নতুন বই ছাপানোর ব্যস্ততা, নতুন বছরের ক্যালেন্ডার, ডায়েরি ও একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবসকেন্দ্রিক নানা আয়োজন নিয়ে ব্যক্তি বা সংগঠনগুলো থেকে কোনো অর্ডার নেই বলে জানান প্রেস ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে বাঁধাই কারখানাগুলোরও একই হাল। অন্য বছরের এদিনগুলোতে নতুন বই, ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, খাতা ও শিক্ষা উপকরণ বাঁধাই কাজে প্রেসপাড়ায় ব্যস্ততা দেখা গেলেও এ বছর সেখানে ভিন্নচিত্র।

প্রেস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান বাজারে দ্রব্যসামগ্রীর সাথে পাল্লা দিয়ে কাগজের দামও বেড়েছে অকল্পনীয়ভাবে। একুশের বইমেলায় নতুন বই ছাপানোসহ কাগজের সাথে সম্পৃক্ত কাজে সাধারণের মধ্যে আগ্রহ একেবারেই নেই। ফলে প্রেস, প্রকাশনা ও বাঁধাই কাজের প্রতিষ্ঠানগুলো অলস সময় কাটাচ্ছে।

চট্টগ্রাম প্রেস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল হারুন সুপ্রভাতকে বলেন, ‘বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সাথে পাল্লা দিয়ে যে হারে কাগজের দাম বেড়েছে তাতে প্রেস-প্রিন্টিং বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়ে আগ্রহ হারাচ্ছে। আগে যে পরিমাণ কাজ ব্যবসায়ীরা পেতো, তার ১০ শতাংশ কাজও এ বছর তারা পাননি। অনেক ব্যবসায়ী এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। উচ্চমূল্যে কাগজ কিনে বই ছাপানো, বাঁধাই, খাতা-ক্যালেন্ডার ইত্যাদি প্রকাশ করতে আগ্রহ হারাচ্ছে ভোক্তারাও।’

তিনি বলেন, ‘এক সময় করপোরেট ব্যবসায়ীরা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো। কিন্তু এখন করপোরেট কোম্পানিগুলো সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেক সেক্টর দখল করে ফেলেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখানে একটি চরম নিকৃষ্ট ব্যবস্থা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এক সময় যে কাগজ ১২০০ টাকায় প্রতি রিম কেনা যেত তা এখন ২৮০০ টাকা। এতো দামে ব্যবসায়ীরা কিভাবে শিক্ষা উপকরণ বের করবে কিংবা সৃজনশীল প্রকাশকেরা নতুন বই বের করবে, তিনি প্রশ্ন রাখেন।’
ভোক্তা অধিকার নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোক্তা অধিকারগুলো আজ কোথায়? প্রশাসন বাজারের সব ব্যবস্থা নির্ধারণ করে দিলেও কাগজের ক্ষেত্রে নীরব কেন? প্রশাসন ছাড়াও শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রকাশনা, কোন সেক্টরে কাগজের প্রয়োজন হয় না? আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো প্রেস-প্রকাশনা ও বাঁধাইশিল্পে যারা জড়িত, তারা তো এ শিল্প থেকে হারিয়ে যাবে।’

জি এ ভবন মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইকবাল উদ্দিন চৌধুরী সুপ্রভাতকে বলেন, ‘অন্যবারের তুলনায় এবার আমরা ২০ শতাংশেরও কম কাজ পেয়েছি। এই ব্যবসায় বেশিদিন থাকতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। প্রকাশনা ব্যবসার মৌসুম চলে যাচ্ছে, কিন্তু ব্যবসা নেই। বিষয়টির প্রতি সরকারের উদাসীনতা ও নীরবতাকে দায়ী করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
সাজেদা ম্যানশনের এসবি প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী জাফরুল ইসলাম বলেন, ‘কাগজের দাম অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়েছে। যে কাগজের রিম ছিল ১৮০০ টাকা তা এখন ৩৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আর যে কাগজের রিম ছিল ২৪০০ টাকা তা এখন ৪২০০ টাকা। এমন অভাবিত দামবৃদ্ধির কারণে প্রকাশনা মালিকেরা স্থবির হয়ে পড়েছেন। গত বছর এই সময়টাতে অনেক কাজ ছিল। আমরা অর্ডার নিয়ে কর্মব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এ বছর একেবারেই বসে আছি।’
ভালো নেই প্রকাশকেরাও

কাগজের দামবৃদ্ধি পাওয়াতে হুমকির মুখে পড়েছে প্রকাশনাশিল্পও। এবার বইমেলায় নগরীর বিভিন্ন প্রকাশনা বই ছাপাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে ন্।া কাগজের এমন চড়াদাম দেশের শিল্পসাহিত্যকে ধ্বংস করার অশনি সংকেত বলে মনে করছেন প্রকাশকেরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলাকা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী, লেখক ও ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বিগত ৬ মাস ধরে কাগজের দাম কেবল বেড়েই চলেছে। শুধু কাগজ না, প্রিন্টিং সম্পর্কিত সকল পণ্যের দামই বাড়তি। এত চড়াদামে বই ছাপতে বিমূখ হচ্ছে লেখকেরা। অন্যবার আমরা ৮০/৯০টির মতো নতুন বই বের করলেও এবার ২৫টির বেশি বই পাইনি। কাগজের বাড়লে তো বইয়ের দামও দ্বিগুণ হবে। এত দামে মানুষ বই কিনবে? আমরা নানাভাবে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনার চেষ্টা করেছি। তাদের নীরবতায় সাহিত্য ও শিক্ষাজগত হুমকির মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, দেশে কাগজ উৎপাদকের অভাব নেই, কিন্তু কিছু সিন্ডিকেট কাগজের বাজার দখল করে নিয়েছে বলে আমি মনে করি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চেরাগী পাহাড়ের নন্দন প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘কাগজের দাম বাড়াতে আমি এবার বই ছাপানোর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি এবং বিরোধিতা করে আসছি। ৩০০ টাকার বই এখন আমাদের ৪৮০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। পাঠক শিক্ষাসাহিত্য বিমুখ হচ্ছে। অন্যবারের তুলনায় এবার এক-তৃতীয়াংশ বই ছাপানো হচ্ছে। আমি মনে করি, অশুভ সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে আমাদের শিক্ষা ও সাহিত্যজগত ধ্বস হয়ে যাচ্ছে। সরকারের দ্রুত এ বিষয়ে ভাবা উচিত ।’

প্রিন্টিং ব্যবসায়ী ও প্রকাশকদের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জেলা সহ-পরিচালক নাসরিন আক্তারের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজের দাম বাড়ছে। বিভিন্ন সূত্রে থেকে আমরা তা জানতে পারছি। তবে আমাদের এখনো বাজার তদারকির নির্দেশ দেয়া হয়নি। নির্দেশ আসলে আমরা বাজার তদারকিতে নামবো।’