জিনাত কিবরিয়া
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ভাষায় সাদা বাংলায় বঙ্গবন্ধু মানে “বাংলার বন্ধু”। শেখ মুজিবুর রহমান অবশ্যই তার চেয়েও বেশি কিছু, তিনি অতুলনীয়। তিনি বাংলাদেশের মহান রাজনৈতিক নায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণার রূপকার, বাংলাদেশিদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক, বাংলার সবচেয়ে নন্দিত মানুষ আর যথার্থই তিনি ‘জাতির পিতা’।
মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বা বাংলার বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করাটা আসলে খুব কম বলা হয়। এর চেয়ে বড় কোন পদবি যে তিনি চাননি, শুধু বন্ধুত্বেই খুশি ছিলেন, যা তাঁর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা। এতে অনুধাবন করা যায় যে তিনি নামের কাঙাল ছিলেন না বরং স্বতর্স্ফূতভাবেই মানুষ তাঁকে ভালোবাসতেন।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভাষণ। বাংলাদেশ পেরিয়ে এই ভাষণ পৃথিবীর নানা প্রান্তে আজ তা গৃহীত ও আলোচিত হয়েছে ও হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের তথ্যগুলো বেশিরভাগ মানুষের জানা আছে। তা সত্ত্বেও শৈশব, কৈশোর, যৌবনের ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর জীবনের দিনগুলো নিয়ে কিছু তথ্য এখানে উপস্থাপন করা হলো।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফুর রহমান ও মোসাম্মৎ সাহারা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান হলেন শেখ মুজিব। মা-বাবা ডাকতেন খোকা বলে। খোকার শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়। তিনি ১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেন। ৯ বছর বয়সে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরে তিনি স্থানীয় মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন।
কৈশোরকালে ১৯৩৪ সালে ১৪ বছর বয়সে তিনি চোখে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। তাই তার একটি চোখ কলকাতায় অপারেশন করা হয় এবং চক্ষু রোগের কারণে তার লেখাপড়ায় সাময়িক বিরতি ঘটে।
চক্ষুরোগে দীর্ঘ ৪ বছর তাঁর শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় স্কুলে ভর্তি হন।
কৈশোরের শেষদিকে ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু ও বেগম ফজিলাতুন্নেছার আনুষ্ঠানিক বিয়ে সম্পন্ন হয়। তাঁরা দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল এর জনক-জননী।
১৯৪২ সালে তিনি মেট্রিক পাস করেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে আই এ ক্লাসে ভর্তি হন এবং বেকার হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয়। বঙ্গবন্ধু সেই বছরই পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জি,এস) নির্বাচিত হন।
১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা দাঙ্গা প্রতিরোধ তৎপরতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের পক্ষে আন্দোলনে সমর্থন দেয়ায় তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে নিজেকে জড়িত করেন।
বঙ্গবন্ধু স্কুল জীবন থেকেই ছিলেন ন্যায়ের জন্য প্রতিবাদী। বিভিন্ন সময় তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ করেছেন। আস্তে আস্তে তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য ন্যায় সঙ্গত প্রতিবাদ করতে থাকেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। এর ভিত্তিতে ১৯৭০ এর নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। অনেক চড়াই উৎরাই এর মধ্য দিয়ে এ সময় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের কাল ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সংবিধানে তিনি স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতার মর্যাদা পান। পাশাপাশি তিনি এই নতুন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি অনুভব করেন বাংলা ভাষার জন্যই পূর্ব বাংলার সব ধর্মের মানুষ যেমন- মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নাগরিকরা মুক্তিযুদ্ধ করে এই দেশটা স্বাধীন করেছেন। যার নাম বাংলাদেশ। যে দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস। তাই আমাদের উচিত হবে বাংলাদেশকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র্র হিসেবে গড়ে তোলা। ধর্ম নিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। তিনি বলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতার মানে এই নয় যে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে না। এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বাধীনতা। ধর্মভীরু মানুষ এটিকে মূল্যবান মনে করে। আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা নিজের ধর্মকে স্বাধীনভাবে পালন করা এবং অন্য ধর্মের মানুষকে তাদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে দেওয়া। সর্বোপরি ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।
১৯৭২ সালে সংসদে যখন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ নবীন গণতন্ত্রের সংবিধান গৃহীত হলো, তখন ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবান আদর্শের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যা বলেছিলেন তার থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি, ‘আমরা ধর্মকে বন্ধ করব না মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।’ মূলত নব্য বাংলাদেশকে তিনি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং এই বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছিলেন। তাঁর স¦প্ন ছিল এদেশের জনগণকে তাদের পাঁচটি মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিতভাবে দেওয়া। যেমন- ১. খাদ্য, ২. বস্ত্র, ৩. বাসস্থান, ৪. শিক্ষা ও ৫. সুচিকিৎসা। বাংলার মানুষ ও মাটিকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। বাংলার মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তাই তো তিনি মাঝে মাঝে বিভিন্ন বক্তৃতায় জনগণকে উদ্দেশ করে বলতেন, ‘ তোমরা আমায় এত ভালোবসো কেন?” কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিটি তাঁকে শান্তিতে দেশ শাসন করতে দেয় নাই। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ আর অন্যদিকে দুষ্ট লোকেরা সবসময় দেশটাকে অস্থিতিশীল করে রাখার জন্য কাজ করতে থাকে।
মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ শাসনকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক কুচক্রী সদস্য তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিয়ূন)। পক্ষান্তরে তিনি হত্যার শিকার হন নি, তিনি শাহাদাত বরণ করেন, তিনি শহীদ হন। কারণ তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি ও একজন দেশপ্রেমিক। তাছাড়া তাঁর বীরত্ব, ত্যাগ, দৃঢ় প্রত্যয়, নেতৃত্বগুণ একজন রাজনীতিক হিসেবে এর সবকটি সম্মিলন দেখেছে জাতি। এসব অসাধারণ গুণই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সহজেই স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতার মর্যাদায় আসীন করেছে। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তিনি স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে। আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নৃশংস ও মর্মস্পর্শী এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ হারায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জাতি গভীরভাবে শোকাহত। তাই তো বলা হয় তুমি রবে বাংলাদেশের মানচিত্র জুড়ে ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অন্তরে।
বঙ্গবন্ধু মাত্র ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন। এরই মধ্যে এই স্বল্প সময়ে পার্থিব জীবনে তিনি হাজার বছরের অর্জন রেখে গিয়েছেন। অন্ধকারের ঘাতকেরা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি ৫৫ বছরের বেশি। কিন্তু তাতে কী! সেই সংক্ষিপ্ত জীবনেই যে তিনি করে গিয়েছেন সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ কাজ। আমাদেরকে তিনি দিয়ে গিয়েছেন নতুন এক জাতি রাষ্ট্র। আর তাঁর প্রেরণায় উজ্জীবিত সেই বহু কোটি মানুষের জাতি আজ এগিয়ে যাচ্ছে তাঁরই আকাক্সিক্ষত স্বপ্নের বাস্তবায়নের দিকে। তাই আজ জাতি ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সকল শহীদদের প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।