নিজস্ব প্রতিবেদক »
নগরে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। স্থানীয় ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রভাবশালী বড় ভাইদের ‘আশ্রয়-প্রশ্রয়ে’ এসব গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে। এসব অপরাধে জড়িত হচ্ছে স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও। এ বিষয়ে পশ্চিমা প্রভাব, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সহজলভ্যতা ও রাজনীতি কেন্দ্রিক ‘বড় ভাইদের আধিপত্যকে’ দুষছেন সংশ্লিষ্টরা।
২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজার একটি শপিং সেন্টারের সামনে থেকে ‘ডট গ্যাং’ নামে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৭ সদস্যকে আটক করে র্যাব।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, নগরের ১৬টি থানা এলাকায় বিভিন্ন নামে প্রায় অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। যারা জড়িয়ে পড়েছে দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কাজে। আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রও।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহাবুব আলম জানান, নগরে অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। যাদের তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। তদন্ত করে সত্যতা পেলে তাদের গ্রেফতারের আওতায় আনা হবে।
স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, নগরের জাতিসংঘ পার্ক, বিপ্লব উদ্যানের আশপাশে, চকবাজার গুলজার মোড়ের পশ্চিমে, বাকলিয়ার চাক্তাই, কোরবানিগঞ্জ, কোতোয়ালীর চেরাগী মোড়, জামালখান মোড়, কদমতলী, বিআরটিসি, নিউমার্কেট, আমতলী, চকবাজার থেকে লালদীঘি এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি। তারা রাস্তায়-অলিতেগলিতে আড্ডা দেয় বেশি। বিভিন্ন স্কুলের মোড়ে মোড়েও দেখা যায়।
কিশোর গ্যাং গ্রুপ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও টিকটকের মাধ্যমে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করছে। মেসেঞ্জার গ্রুপে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে নানা ধরনের অপারেশন পরিচালনাসহ মুহূর্তের মধ্যেই তারা একত্রিত হচ্ছে। এসব গ্যাংয়ের বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১২-১৮ বছর। গাঁজা, ইয়াবা, ধূমপানসহ সব ধরনের নেশায় তারা আসক্ত। নিজেদের মধ্যে বেশিরভাগ মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে এসব গ্যাং। কার চেয়ে কে শক্তিশালী-এ দ্বন্দ্বেই মুহূর্তের মধ্যেই তারা নানা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক গ্যাংগুলো নিরীহ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করছে।
র্যাব সূত্র জানায়, চকবাজার থেকে যে সাতজন কিশোর গ্যাং সদস্য আটক করা হয়েছে তারা স্বনামধন্য স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। তারা এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২ জন, চট্টগ্রাম মুসলিম সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২ জন এবং নাসিরাবাদ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২ জনসহ সর্বমোট ৬ জন ছাত্র রয়েছে। তারা একটি কোচিং সেন্টারের নিয়মিত ছাত্র ছিলো। সেখানে থেকে তাদের সবার পরিচয়। পরে আড্ডা দেওয়ার সময় কথিত একটি গ্রুপ তাদের কাজে বাধা দিতে থাকে এবং মারধর করে। মূলত এখান থেকে ‘ডট গ্যাং’ গ্রুপটির কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম থেকেই গ্রুপটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল গ্রেফতারকৃত হোসাইনুল আমিন মিম। সে নিজের নামে পেজ এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করে সেখানে তাদের কার্যক্রমের বিভিন্ন স্থির চিত্র এবং ভিডিও আপলোড করত। তারা নগরীর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করে ইভটিজিং, ছিনতাই, দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা- করতো। তাদের এমন কর্মকা-ে স্থানীয় ‘বড় ভাইরা’ মদদ দিচ্ছে।
কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের উপ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, ‘কিশোর গ্যাং বেড়ে যাওয়ার কারণ মূলত তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও পশ্চিমা সংস্কৃতি। কিশোররা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিমুখ হচ্ছে। আমি মনে করি, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা ও শাসনের কোনো বিকল্প নেই।’
কিশোর অপরাধের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘সমাজে অপরাধের মাত্রা তখনই সৃষ্টি হয় যখন অপরাধগুলোর বিচার হয় না। একজন কিশোর যখন বুঝতে পারে তার অপরাধগুলোর কোন বিচার হচ্ছে না, তখন সে আরও বেশি অপরাধে সক্রিয় হয়। তাছাড়া বর্তমান আমাদের সমাজে উচ্চবিত্তশালী ও বঞ্চিত শ্রেণির কিশোররা অপরাধে দ্রুত জড়িয়ে পড়ছে। কারণ সমাজে উচ্চবিত্তশালী পরিবারগুলোর অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রতি তেমন দায়িত্ব পালন করতে পারছে না নানা ব্যস্ততায়। বঞ্চিত শ্রেণির পরিবারে বেড়ে ওঠা কিশোররা বুঝতে পারে, তারা সবকিছু থেকে বঞ্চিত। কাজেই তারা অপরাধে লিপ্ত হয়। সুতরাং কিশোর গ্যাং কমাতে হলে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, সাহিত্যচর্চার দিকে কিশোরদের মনোনিবেশ করাতে হবে।’
চট্টগ্রাম জেলা দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, ‘১৮ বছর বয়স বা তার কম বয়সী কিশোর অপরাধের সাথে যারা বেশি লিপ্ত হচ্ছে তার জন্য আমি দায়ী করবো পরিবারের শাসনকে। আইন বা পুলিশ দিয়ে সব অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। কিছু অপরাধের জন্য আমরা অভিভাবকরা নিজেরাই দায়ী।
এলাকার রাজনীতিক বড়ভাইদের ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি মহান পেশা। সবার পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব না। এখন রাজনীতি বিষয়ে ভালো যে বুঝেন না তিনিও রাজনীতিতে লিপ্ত হচ্ছেন। একজন কিশোর বুঝতে পারছে না তার অপরাধগুলো আসলে কোথায়। কাজেই তার অপরাধগুলোর সাথে রাজনীতির মতো মহান পেশাও কলঙ্কিত হচ্ছে। সুতরাং পরিবারকে তদারকি করতে হবে তাদের সন্তানরা রাজনীতিক চর্চার নামে কি করছে। সন্তানের নিত্য চাহিদা কারা পূরণ করছে, কেন করছে। এসব বিষয় ভাবতে হবে আগে পরিবারকে’।