নিজস্ব প্রতিবেদক »
দেশীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা প্রধান শিল্প হলো পোশাক খাতে। তাই এই খাতের ওপর নির্ভরশীল রয়েছে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ও ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বেকারত্ব নিরসনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে পোশাক শিল্প। কিন্তু নানা সংকটে এ শিল্পের বর্তমান অবস্থা নাজুক। এরমধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকা এবং ক্রয়াদেশ কমে যাওয়াকে অন্যতম সমস্যা। এ সংকট থেকে পোশাক শিল্পের উত্তরণ না হলে আগামীতে দেশীয় অর্থনীতিতে মন্দা ও বেকারত্বে সমস্যা বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্যমতে, চট্টগ্রামে তালিকাভুক্ত ৭৬টি কারখানা রয়েছে। এ তালিকার বাইরে উৎপাদনে সচল রয়েছে আরও ১৭৪টি কারখানা। এর পাশাপাশি প্রায় ২০০টির মতো ছোট কারখানা চুক্তিতে কাজ করছে বড় পোশাক কারখানাগুলোর সঙ্গে। সবমিলিয়ে ৪৫০টির মতো কারখানা সচল রয়েছে। কিন্তু গত তিন মাসে এসব কারখানায় ৪০ ভাগ কার্যাদেশ কমে গেছে। চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে সবমিলিয়ে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার কার্যাদেশ আসার কথা থাকলেও চলতি বছরে এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার কার্যাদেশ কমে গেছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিশে^র বিভিন্ন দেশে পাঠানো চার হাজার ৩০৪ কোটি ডলার পণ্যের মধ্যে তিন হাজার ৫৩৬ কোটি ডলারের পোশাক রয়েছে। অর্থাৎ রফতানি করা বিভিন্ন পণ্যের ৮৮ ভাগ ছিল পোশাক। কিন্তু চলতি বছরে পোশাক রফতানি ক্রমশ কমে গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে ৪৯০ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪৮৫ কোটি তিন লাখ ৭১ হাজার ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ৪২৯ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, মার্চ মাসে ৪৭৬ কোটি ২৩ লাখ ডলার, এপ্রিল মাসে ৪৭৪ কোটি ডলার ও জুন মাসে ৪৯১ কোটি ডলার পোশাকপণ্য ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে। জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে ৯৬ কোটি টাকা রফতানি কমেছে। জুলাইয়ের পর রফতানি কমেছিল আগস্টে। সেপ্টেম্বরে তা আরও কমেছে। সর্বশেষ অক্টোবরে রফতানি কমেছে ২০ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে কথা হলে বিজিএমইএ প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পোশাক কারখানাগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বায়াররা পণ্য নিচ্ছেন না। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। তারা প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে বিলাসিতা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এতে পোশাক বিক্রি সাংঘাতিকভাবে কমে গেছে। এছাড়া যেসব পোশাক আমাদের কাছে তৈরি করা আছে সেগুলো সামারের (গ্রীষ্ম)। এদিকে শীত চলে আসছে। সামারের এসব পোশাকের বাজার এমনিতেই কমে যাবে। এরপরও বায়াররা শিপমেন্ট ডেট (সময়) পিছিয়ে দিচ্ছে।’
ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্ডার কমে গেছে। মাস দুয়েক আগেও যেভাবে অর্ডার আসছিল এখন তা আনুমানিক চল্লিশ শতাংশ কমে গেছে। বর্তমানে যা অর্ডার আছে সেসব পণ্যও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ঠিকভাবে তৈরি করা যাচ্ছে না। বিদেশে যদি এই মেসেজ যায় তাহলে সংকট আরও বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা মালিক যথাসময়ে শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না। এভাবে চলতে থাকলে কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাড়তি দামে হলেও গার্মেন্টস সেক্টরে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া জরুরি।’
একই প্রসঙ্গে বিজিএমইএ-এর সাবেক পরিচালক ও চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ বলেন, ‘ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া ও শিপমেন্টের ডেট (সময়) পিছিয়ে দেওয়ায় আমরা স্বাভাবিকভাবে সংকটে পড়েছি। শিপমেন্ট ডেট যদি দুই মাসও পিছিয়ে দেয়, তাহলে অনেক গার্মেন্টস মালিকদের বেতন পরিশোধে হিমশিম খেতে হয়। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ নিরবচ্ছিন্ন না থাকায় অনেক দামি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ছে। এভাবে সংকট সব এক হলে গার্মেন্টস মালিকরা ব্যবসা ছেড়ে দিবে। এতে বেকারত্বের সমস্যা আরও বেড়ে যাবে।’
পোশাক খাতের ধস হলে দেশীয় অর্থনীতির পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক সংকট বেড়ে যাওয়ার শংকা প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীরা। এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় প্রসঙ্গে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সেলিমউল্লাহর সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘দেশীয় অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান দৃশ্যত। পাশাপাশি এ শিল্পের ওপর ব্যাংক, বীমা, বন্দর, কাস্টমস, সিএন্ডএফ এজেন্ট, শিপিং সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয় নির্ভর করে। তাই বিকল্প কোনো শিল্প গড়ে না ওঠা পর্যন্ত এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। তাই সরকারকে আন্তরিকভাবে দেশের জ্বালানি সমস্যার সমাধান ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। পাশাপশি রিজার্ভের দিকেও নজর রাখতে হবে। তবে সব কাজ সরকারের একার নয়। আমাদেরও সাশ্রয়ী হতে হবে। উন্নত দেশের মানুষেরা বিলাসিতা ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের সামর্থ্য থাকলেও বিলাসিতা পরিহার করতে হবে।’